Image description

দেশে গত তিন বছর ধরে স্বর্ণবাজারে দামের ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতি বজায় রয়েছে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া এই বৃদ্ধির ধারা এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। দামের এই ঊর্ধ্বগতি শুধু সাম্প্রতিক নয়। দুই দশকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০০ সালে প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম ছিল মাত্র ৬,৯০০ টাকা। এক দশক পর ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২,১৬৫ টাকা। ২০২০ সালে দাম ছুঁয়েছিল প্রায় ৭০ হাজার টাকার ঘর, আর ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো স্বর্ণের দাম এক লাখ টাকা অতিক্রম করে। এখন দামের ঘর পেরিয়েছে প্রায় সোয়া দুই লাখের কাছাকাছি— যা দেশের স্বর্ণবাজারে এক ঐতিহাসিক রেকর্ড। মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) ২২ ক্যারেটের এক ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণের দাম বাড়িয়ে ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

আগের দিন সোমবার (১৩ অক্টোবর) ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ২ লাখ ১৩ হাজার ৭১৯ টাকা। অর্থাৎ মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সোনার নতুন রেকর্ড তৈরি হলো। এই পণ্যটির দাম শুধু দেশে বেড়েছে এমন নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও স্বর্ণের দাম এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্তর ছাড়িয়েছে। সোমবার (১৩ অক্টোবর) যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে (১৪৫০ জিএমটি) স্পট মার্কেটে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৯৯ দশমিক ৫৫ ডলার, কিছু সময়ের জন্য তা ছুঁয়ে ফেলে ৪ হাজার ১০৩ দশমিক ৫৮ ডলার।

কেন বাড়ছে দাম

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্থরতা, আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক অনিশ্চয়তার প্রভাবেই বিনিয়োগকারীরা ক্রমশ স্বর্ণের দিকে ঝুঁকছেন। নিরাপদ বিনিয়োগ-মাধ্যম হিসেবে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের চাহিদা বাড়ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের বাজারেও।

বাজারে প্রভাব

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান মনে করেন, বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে দাম আরও বাড়তে পারে। তার ভাষায়, “স্বর্ণের ভবিষ্যৎ মূল্য পুরোপুরি নির্ভর করছে বৈশ্বিক বাজার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্বর্ণ মজুত নীতির ওপর। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বাড়লে দেশের বাজারেও দাম বৃদ্ধির এ ধারা অস্বাভাবিক নয়।”

তবে এর ফলে সাধারণ ক্রেতারা বিপাকে পড়ছেন। মাসুদুর রহমান বলেন, “সোনার দাম এখন অনেকের নাগালের বাইরে চলে গেছে। বিক্রি কমে যাওয়ায় অনেক কারিগর বেকার হয়ে পড়ছেন।”

আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের ঊর্ধ্বমুখী দামের প্রভাব কেবল বাংলাদেশেই পড়েনি, দক্ষিণ এশিয়ার বাজারেও তৈরি হয়েছে নতুন রেকর্ড।

স্বর্ণের দামের এই ঊর্ধ্বগতি দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই প্রভাব ফেলেছে—বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপের বাজারে।

বাংলাদেশ: রেকর্ড দামে নতুন ইতিহাস

বাংলাদেশের বাজারে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে স্বর্ণ। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) সর্বশেষ যে দাম ঘোষণা করেছে, তাতে ২২ ক্যারেট সোনার প্রতি ভরির দাম দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৩২ টাকা। আর প্রতি গ্রাম স্বর্ণের দাম ১৮ হাজার ৫৪৭ টাকা। বর্তমানে ১ মার্কিন ডলার সমান প্রায় ১২১ টাকা ৮০ পয়সা।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, টাকার অবমূল্যায়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তেজাবি স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধি—এই দুই কারণেই দেশে স্বর্ণের দাম লাগাতার বেড়েছে।

এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেছেন, দেশের স্বর্ণ ব্যবসা এখন মূলত করপোরেট গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এই প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করায় স্বর্ণের দাম বেপরোয়া হারে বেড়ে চলেছে, ফলে সাধারণ ক্রেতারা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “বিয়ে বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে স্বর্ণ কেনা এখন অনেক পরিবারের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শখের বশে যারা আগে স্বর্ণ ব্যবহার করতেন, তারাও এখন তা কিনতে পারছেন না। এটি মূলত এক ধরনের কারসাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।”

তিনি আরও বলেন, ‘‘স্বর্ণের বাজার সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আগে পার্শ্ববর্তী দেশে স্বর্ণপাচারের অভিযোগ শোনা যেত, কিন্তু এখন আরও বড় উদ্বেগের বিষয় হলো—দেশের অভ্যন্তরে করপোরেট ব্যবসায়ীরাই এই বাজারকে প্রভাবিত করছে।’’

নাজের হোসাইন মনে করেন, স্বর্ণ ব্যবসায় এমনিতেই নানা ফাঁকফোকর ও অনিয়ম রয়েছে। তার সঙ্গে করপোরেট গ্রুপগুলোর প্রভাব যুক্ত হওয়ায় বাজার এখন আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, “স্বর্ণ ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ আনতে হলে সরকারের উচিত উপযুক্ত আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করা। এতে ভোক্তা স্বার্থ রক্ষা সম্ভব হবে এবং বাজারে স্বচ্ছতা আসবে।”

স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে এখন এমন অবস্থা যে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য স্বর্ণ কেনা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এক সময় বিয়ে, উৎসব কিংবা ভবিষ্যৎ সঞ্চয়ের নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে স্বর্ণ কেনা ছিল পারিবারিক সংস্কৃতির অংশ, এখন তা বিলাসপণ্যে পরিণত হয়েছে।

ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকার এক জুয়েলার্স মালিক বলেন, “আগে প্রতিদিনই কেউ না কেউ গয়না বানাতে বা পুরোনো গয়না বদলাতে দোকানে আসতেন। এখন অনেকে শুধু দেখতে আসেন, কিনতে পারেন না। ক্রেতা কমেছে, কিন্তু দাম বাড়ছেই।”

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী তাঁতিবাজারের প্রবীণ স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোবিন্দ হালদার প্রায় পাঁচ দশক এই পেশায় যুক্ত। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, “স্বাধীনতার আগে গিনি স্বর্ণের দাম ছিল ভরি মাত্র দেড়শত টাকা। তখনও মানুষ বলতো দাম বেশি। কিন্তু এখন তো অবস্থা আরও কঠিন হয়ে গেছে।”

ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের গুলশান শাখার ইনচার্জ সাগর সরকার জানান, সাধারণত স্বর্ণের দাম বাড়লে বিক্রি কিছুটা বাড়ে। কারণ মানুষ ধরে নেয় দাম আরও বাড়বে। কিন্তু এবার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। “অনেক ক্রেতাই এখন আর স্বর্ণ কেনার সামর্থ্য রাখছেন না,” বলেন তিনি।

ভারতে তুলনামূলক দাম কিছুটা কম

ভারতের স্বর্ণবাজারে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে বাংলাদেশ থেকে তা কিছুটা কম। মুম্বাই বাজারে বুধবার (১৫ অক্টোবর) ২৪ ক্যারেট পাকা সোনার প্রতি গ্রামের দাম দাঁড়িয়েছে ১২,৪৫৩ ভারতীয় টাকা, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫,৯১৬ টাকা। ১ ভরি (১১.৬৬ গ্রাম) স্বর্ণের দাম দাঁড়ায় প্রায় ১,৮৫,৫৮০ টাকা।

২২ ক্যারেটের হলমার্ক সোনার দাম কিছুটা কম। প্রতি গ্রামের দাম প্রায় ১১,৮৬০ ভারতীয় টাকা, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৫,৯০০-১৫,৯২০ টাকার মধ্যে।

বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের বিশাল স্বর্ণবাজারে দামের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমদানি শুল্ক এবং উৎসব মৌসুমে চাহিদার ঊর্ধ্বগতি। এই কারণে, ভারতের বাজারে দাম তুলনামূলক কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম কিছুটা বেশি রয়েছে।

স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎসব ও বিয়ে বাড়ির চাহিদা বেড়ে গেলে স্বর্ণের দাম স্বাভাবিকভাবেই ওঠানামা করে। তবে বর্তমানে ভারতীয় বাজারে দাম কিছুটা কম থাকায় বাংলাদেশি ক্রেতাদের জন্য অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী অবস্থা দেখা দিয়েছে।

পাকিস্তানে রুপির দরপতনে দাম বেড়েছে দ্বিগুণ

পাকিস্তানের মুদ্রা রুপি তীব্রভাবে অবমূল্যায়িত হওয়ায় স্থানীয় বাজারে স্বর্ণের দাম অনেক বেড়ে গেছে। গত শুক্রবার (১০ অক্টোবর) সবচেয়ে ভালো মানের স্বর্ণ, অর্থাৎ ২৪ ক্যারেটের ১ গ্রাম স্বর্ণের দাম ছিল ৩৬,৭৮৮ পাকিস্তানি টাকা, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫,৮৭০ টাকা। প্রতি ভরির দাম এটি দাঁড়ায় প্রায় ১,৮৫,০০০ টাকা। দুদিন বাজার বন্ধ থাকার পর সোমবার দাম আরও কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে এক গ্রাম স্বর্ণ ৩৭,০২১ পাকিস্তানি টাকায় উঠেছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫,৯০০ টাকা এবং প্রতি ভরিতে প্রায় ১,৮৫,৫০০ টাকা।

দেশটিতে অন্যান্য ক্যারেটের স্বর্ণের দামও বেড়েছে। ২২ ক্যারেটের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৪,৫০০ টাকা প্রতি গ্রাম এবং প্রতি ভরিতে প্রায় ১,৬৯,০০০ টাকা। ২১ ক্যারেটের দাম প্রতি গ্রামে প্রায় ১৩,৯০০ টাকা এবং প্রতি ভরিতে প্রায় ১,৬২,০০০ টাকা। ১৮ ক্যারেটের জন্য দাম পড়েছে প্রতি গ্রামে ১২,০০০ টাকা এবং প্রতি ভরিতে প্রায় ১,৪০,০০০ টাকা।

শ্রীলঙ্কায় কত?

আইএমএফের সহায়তার পর শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও কলম্বোর বাজারে স্বর্ণের দাম বাংলাদেশের তুলনায় কিছুটা কম। সোমবার (১৪ অক্টোবর) ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি গ্রাম বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার ৬২০ শ্রীলঙ্কান রুপিতে। দেশটিতে বর্তমানে ১ মার্কিন ডলার সমান ৩০২ দশমিক ৮৫ রুপি। বাংলাদেশি টাকায় হিসাব করলে এক ভরি স্বর্ণের দাম দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার ৫০০ টাকা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঋণ সংকট কাটিয়ে উঠলেও জনগণের মধ্যে স্বর্ণের প্রতি আস্থা কমেনি। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও সঞ্চয়ের বিকল্প সংকটের মধ্যেই স্বর্ণ এখনও শ্রীলঙ্কার নিরাপদ বিনিয়োগের প্রতীক।

নেপালে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম কত?

নেপালের বাজারে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম বর্তমানে প্রতি গ্রাম প্রায় ১০,৮৯২ নেপালি রুপি, যা বর্তমান বিনিময় হারের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯,৩৬৬ টাকা।

এক ভরির (১১.৬৬ গ্রাম) স্বর্ণের দাম নেপালি রুপিতে প্রায় ১,২৬,৯০০— যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১,০৯,১৫০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করান, নেপালের স্বর্ণবাজার মূলত উৎসব মৌসুম ও বিনিয়োগের কারণে তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকে। তবে আন্তর্জাতিক স্বর্ণমূল্য ও নেপালি রুপির বিনিময় হার ওঠানামার সঙ্গে দাম সামান্য পরিবর্তিত হতে পারে।

ভুটানে স্বর্ণের বাজার ছোট হলেও ক্রেতা সচেতন

ভুটানের মুদ্রা ‘নুলট্রাম’ ভারতীয় রুপির সমমূল্যে বিনিময় হওয়ায় দেশটির স্বর্ণের দামও প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সমানতালে চলে। থিম্পুর বাজারে বর্তমানে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি গ্রামের দাম দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮৯৮ নুলট্রামে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৪ হাজার ৯০০ টাকার সমান। এর ভিত্তিতে, প্রতি ভরির দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় পৌঁছেছে প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৭৯৩ টাকা।

বাজারের আকার ছোট হলেও ভুটানে স্বর্ণের চাহিদা এখনও স্থিতিশীল। বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মীয় উৎসব, বিয়ে এবং পারিবারিক রীতিনীতির কারণে স্বর্ণ কেনাবেচা দেশটির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে রয়ে গেছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমিত পরিসরের বাজার সত্ত্বেও এ চাহিদা স্বর্ণের স্থিতিশীল মূল্য বজায় রাখতে সহায়তা করছে।

মালদ্বীপে পর্যটন আয়ের ভরসায় দামে স্থিতি

পর্যটননির্ভর দেশ মালদ্বীপেও স্বর্ণের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। রাজধানী মালেতে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি গ্রাম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮৮৫ মালদ্বিয়ান রুফিয়ায়। দেশটিতে মুদ্রার মান বর্তমানে ১ ডলার সমান ১৫ দশমিক ৪ রুফিয়া, যা বাংলাদেশি টাকায় এক ভরি প্রায় ১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।

বিশ্লেষকদের মতে, মালদ্বীপে পর্যটন থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করছে, তবে বিশ্ববাজারের প্রভাব এখানেও পড়ছে স্পষ্টভাবে।

বিনিময় হারই মূল নিয়ামক

বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার স্বর্ণবাজারে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলছে স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার। টাকার তুলনায় ভারতীয় রুপি কিছুটা স্থিতিশীল, কিন্তু পাকিস্তানি রুপি ও শ্রীলঙ্কান রুপি বড় আকারে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ডলারের বিপরীতে মুদ্রার দর কমলে আমদানি ব্যয় বাড়ে, যা সরাসরি স্বর্ণের দামে প্রতিফলিত হয়।

ডলারের বিনিময় হারও দেশের স্বর্ণ কেনায় সরাসরি প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে এক ডলারের বিনিময়মূল্য এখন প্রায় ১২১.৮০ টাকা, ভারতের বাজারে ৮৭.৭৮ রুপি, পাকিস্তানে ২৮৩.৫৮ রুপি, নেপালে ১৪২.১১ রুপি, ভুটানে ৮৬.৫৮ টাকা, শ্রীলঙ্কায় ৩০২ রুপি এবং মালদ্বীপে ১৫.৪১ রুফিয়া। অর্থাৎ মুদ্রার মানের তারতম্য স্বর্ণ ক্রয়ের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামা এবং স্থানীয় মুদ্রার মানের পরিবর্তনের প্রভাবে স্বর্ণের দাম আরও অস্থির হতে পারে। উৎসব ও বিবাহ মৌসুমের চাহিদা এবং বিনিয়োগের জন্য ক্রয় প্রবণতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে স্বর্ণের বাজার শীর্ষে রয়েছে। ক্রেতাদের সতর্ক থাকা, বাজার পর্যবেক্ষণ করা এবং সঠিক সময়ে বিনিয়োগ করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “যেসব দেশে ডলার সংকট বা মুদ্রার অবমূল্যায়ন বেশি, সেখানে স্বর্ণের দামও তুলনামূলক বেশি। এটি এক ধরনের ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রতিফলন’।’’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে এখন স্বর্ণের দাম এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। প্রতিটি দেশের অর্থনীতি, মুদ্রানীতি এবং আন্তর্জাতিক বাজারের চাপ আলাদা হলেও সামগ্রিক চিত্র একটাই—স্বর্ণ এখন আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি দামি এবং চাহিদাসম্পন্ন।

বাংলাদেশে দাম সর্বাধিক হলেও বিনিয়োগকারীরা এটিকে কেবল বিলাসী ধাতু নয়, বরং নিরাপদ সম্পদ হিসেবে দেখছেন। বিশ্ববাজারে অস্থিরতা যতদিন থাকবে, দক্ষিণ এশিয়ার বাজারেও স্বর্ণের এই ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকার আশঙ্কাই বেশি।