Image description

লাশ কাটা ঘর বা মর্গ। খুন, দুর্ঘটনা, আত্মহত্যাসহ সন্দেহজনক লাশ রাখা হয় এই মর্গে। যা ডোম ঘর নামেও পরিচিত। যেখানে লাশ কাটাছেঁড়া করে মৃত্যুর কারণ নির্ধারণ করেন চিকিৎসক। আর লাশ কাটাছেঁড়ার জন্য রয়েছে ডোম। রাজধানীর তিনটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপতালে রয়েছে মর্গ। মর্গে রাখা লাশের ময়নাতদন্ত করে হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ। কিন্তু মর্গ রয়েছে সেই আদিম যুগেই। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি এখনো।  
২০২০ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, সারা দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৬৬টি মর্গ রয়েছে। এরমধ্যে রাজধানীতে ৩টি। ঢাকা শহরের মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্যে সর্বেশেষ শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গ স্থাপন করা হয়। 

ঢামেক মর্গের নিজস্ব সবক’টি ফ্রিজই অকেজো: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের নিজস্ব লাশ রাখার জন্য ৫টি ফ্রিজের সবক’টিই অকেজো। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. কাজী গোলাম মোখলেসুর রহমান বলেন,  মর্গে মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য হাসপাতালের নিজস্ব ৫টি ফ্রিজ ছিল, তবে এই মুহূর্তে ৫টি ফ্রিজই বিকল। এর মধ্যে ৩টি ফ্রিজ প্রায় সাত বছর আগে থেকেই নষ্ট। এর বাইরেও একটি মাত্র সচল ফ্রিজ যা ইন্টারন্যাশনাল কমিটি ফর  রেডক্রস (আইসিআরসি) সোসাইটির ডোনেশনে পাওয়া। সেই ফ্রিজেই সংরক্ষণ করা হচ্ছে মরদেহগুলো। আশপাশের সর্বমোট ১৭টি থানার লাশ আসে এখানে। ধারণক্ষমতা বেশি হলেও এই একটা ফ্রিজ দিয়ে চলে না মৃতদেহ সংরক্ষণ সেবা। নষ্ট ফ্রিজগুলোর প্রতিটিতে চার থেকে ৬টি মৃতদেহ রাখা যেতো। বর্তমানে সচল ফ্রিজে ৪৬টি মরদেহ রাখা যায়। 
ঢামেক সূত্রমতে, গতবছর ঢামেক ফরেনসিক বিভাগে মোট ২০৯৬ টি লাশের সুরতহাল করা হয়েছে। গড়ে প্রতিমাসে ২৭৬টি মৃতদেহের সুরতহাল করা হয় ঢামেকে। এছাড়াও মর্গে মৃতদেহ সংরক্ষণাগারে এখনো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত অজ্ঞাতনামা ৭টি লাশসহ ৭ থেকে ৮ জন বিদেশি নাগরিকের লাশও জমা আছে ফ্রিজে। এ বিষয়ে অধ্যাপক ডা. কাজী গোলাম মোখলেসুর রহমান বলেন, একটামাত্র ফ্রিজ দিয়ে আমাদের হয় না। কমপক্ষে ৪/৫ টা ফ্রিজ লাগে। ঢাকা মেডিকেলে সারা দেশ থেকেই লাশ আসে। নির্দিষ্ট থানা ব্যতিত অন্য থানার লাশও সঠিক সুরতহালের জন্য এখানে আনা হয় অনেক সময়। তাই এখানে পর্যাপ্ত ফ্রিজিং ব্যবস্থা থাকা দরকার। কর্তৃপক্ষকে বলেছি এ বিষয়ে এখনো সমাধান হয়নি।  

নাজুক অবস্থা সলিমুল্লাহ মেডিকেলের মর্গ: দেশের অন্যতম ও প্রাচীন সরকারি হাসপাতাল স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। তালাবদ্ধ পড়ে আছে মর্গটি। একটু পরেই আসে মর্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডোম সহকারী। মিনিটছয়েক থেকে আবারও তালা বন্ধ করে বের হয়ে পড়েন তিনি। তার কিছুক্ষণ পরেই ভ্যানে করে একটি লাশ নিয়ে এলে ভ্যানসহ লাশটি পড়ে থাকে মর্গের সামনে। সরজমিন দেখা গেছে, হাসপাতালের অনেকটা পরিত্যক্ত একটি জায়গায় পড়ে আছে লাশ রাখার এ ঘরটি। আশপাশে গাছপালার ঝোপ, পেছনে বাবুবাজার ব্রিজ, সামনের ফাঁকা জায়গায় সারি করে রাখা হয়েছে এম্বুলেন্স। টিনশেড়, পুরাতন জরাজীর্ণ। ভেতরে অকেজো ফ্রিজগুলো পড়ে আছে, সামান্য জায়গার এই মর্গে অনেকটা জায়গা দখল করে আছে এই অকেজো ফ্রিজগুলো।    

সার্বিক বিষয়ে হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিভাগীয় প্রধান ও ডা. নাজমুন নাহার রোজী কোনো তথ্য দিবেন না বলে জানান। তবে সুযোগ- সুবিধার অপ্রতুলতার কথা স্বীকার করে বলেন, আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে তা ঠিক, কিন্তু সবাইকে নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। 

মর্গের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. মোহাম্মদ মাজহারুল শাহীন বলেন, আমাদের জায়গা সংকট। অনেক লিমিটেশনের মাধ্যমে  হাসপাতাল চালাচ্ছি। আর মর্গের অবস্থা জানতে হলে সংশ্লিষ্ট বিভাগে যেতে হবে। বিভাগই ভালো বলতে পারবে। 

সর্বশেষ সংযোজিত মর্গে নিম্নমানের ফ্রিজ: প্রতিষ্ঠার ১২ বছর পর ২০১৭ সালে শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গ চালু করা হয়। মর্গটি নির্মাণে দুই কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল। মর্গে ৯টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (মরচুয়ারি) লাশ রাখার ব্যবস্থা করা হলেও তখন স্থাপিত এসব মরচুয়ারি বা ফ্রিজিং ব্যবস্থার সবগুলোই এখন মোটামুটি অকেজো। ৯টি হীমাগারের ১টি চেম্বার ভালো রয়েছে যেখানে একটিমাত্র লাশ সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকলেও ফ্রিজিং ব্যবস্থার অপ্রতুলতার জন্য একাধিক লাশ সেখানে রাখা হচ্ছে। বর্তমানে হাসপাতালের নতুন স্থাপিত ১২টি মরচুয়ারি রয়েছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে- ফ্রিজগুলো খুব কম দামে কেনা এসব যা বাসা বাড়িতে ব্যবহার করার ফ্রিজিং মেশিনের মতোই কাজ করে। ফ্রিজের বরফ হয় না, সর্বনিম্নতাপমাত্রায় রাখলেও বরফ হয় না। সর্বনিম্ন যে তাপমাত্রায় মরদেহ সংরক্ষণ করলে দেহ অক্ষত থাকবে সে তাপমাত্রায় ও চলে না ফ্রিজগুলো। নিম্নমানের কেনা এসব ফ্রিজে মৃতদেহ সংরক্ষণের মতো পরিবেশ না থাকলেও রাখা হচ্ছে মরদেহ।   

সরজমিন হাসপাতালের লাশ রাখার ঘর, ময়নাতদন্ত কক্ষ ঘুরে দেখা গেল, হাসপাতালের পুরাতন মরচুয়ারিগুলোর অকেজো ৬টি সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে সচল মরচুয়ারিগুলোর পাশে। বাকি তিনটি মরচুয়ারি মর্গের বারান্দায় রাখা হয়েছে। বারান্দার তিনটির মধ্যে একটির চেম্বারে রাখা যায় লাশ। জানা গেছে, ওই সচল চেম্বারে পুরাতন বিদেশি নাগরিকদের লাশ সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। লাশ রাখার ঘরে অকেজো মরচুয়ারিগুলো  মেরামতের বিষয়ে মর্গের ডোম একাধিকবার কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন বলে জানা গেছে।  

ডোমের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হলে ফরেনসিক বিভাগের মর্গের ডোম যতন কুমার বলেন, ‘মর্গে ১২টি ফ্রিজ সচল আছে। ৯টা ফ্রিজ ছিল শুরুতে। সেগুলো অকেজো হয়ে গেছে। নতুন ১২ টা খুব একটা ভালো না। আইস জমে না ঠিকমতো। আর পুরাতনগুলোর মধ্যে একটা চেম্বার ভালো আছে। পুরাতনগুলো পড়ে আছে। ঠিক করানোর জন্য কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’ 

শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গ চালু হওয়ার পর শুরুর দিকে ১২টি থানার লাশ নিয়ে আসার কথা ছিল। ১২টি থানা হলো: মিরপুর মডেল, পল্লবী, কাফরুল, দারুস সালাম, শাহ্‌ আলী, ভাষানটেক, রূপনগর, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, আদাবর ও শেরেবাংলা নগর থানা। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় ২৮ থেকে ৩০টা থানার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে আশা হয় সোহ্‌রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গে। গতবছর সোহ্‌রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গে ১১৫১টি মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। সে হিসাবে গড়ে মাসে ৩৮টি মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয় হাসপাতালটিতে।  

এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক  ডা. মোহাম্মদ শফিউর রহমান বলেন, আমাদের এখানে একটা মর্গ আছে কিন্তু এটা সিস্টেমের কারণে খুব ভালো কাজ করে না। আমরা ফ্রিজ মেরামত করার উদ্যোগ নিয়েছি। নিতমতান্ত্রিক উপায়ে মেরামত হচ্ছে। আশা করি এটা সমাধান হয়ে যাবে।