Image description

চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প বাস্তবায়নে পদে পদে গুরুতর অনিয়ম করা হয়েছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে মেয়াদ শেষ হওয়ার ৬ মাস পর সংশোধন প্রস্তাব দেওয়া হয়। খরচ না বাড়িয়ে ৫৫ কোটি টাকা সাশ্রয়ের কথা বলা হলেও চতুরতার আশ্রয় নিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনার কথা বলা হচ্ছে। প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফ্ল্যাড ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ। এ দুটি কাজ ঘিরে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বেশিরভাগ কাজ শেষ না করেই কিলোমিটার প্রতি ফ্ল্যাডওয়াল নির্মাণ ব্যয় ১৯ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ ৫ বছরে ৫ ভাগ কাজও শেষ হয়নি। অপরদিকে রিটেইনিং ওয়ালের কাজ প্রায় শেষ হলেও এখন অতিরিক্ত প্রায় ২৭৯ কোটি টাকা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে, যা রীতিমতো বিস্ময়কর। এভাবে চট্টগ্রামবাসীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ঘিরে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ চাউর হচ্ছে।

প্রকল্পের এসব চিত্র বেরিয়ে আসে ১৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্পের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায়। সভা থেকে উল্লিখিত এসব প্রশ্নের ব্যাখ্যাসহ সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব নতুন করে পাঠাতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. আখতার কবির চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, চট্টগ্রামের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পে এমন নিয়মের ব্যত্যয় কাম্য নয়। কেননা একটু বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রাম শহর ডুবে যায়। ড্রেনে পড়ে মানুষ মারাও যাচ্ছেন। সেখানে একটি প্রকল্প বছরের পর বছর চলবে, কিন্তু শেষ হবে না, আবার কার্যকর বাস্তবায়নও হবে না, এটা মেনে নেওয়া যায় না। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না হওয়ায় দেখা যায়, বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রকল্পগুলোতে মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা চালাকির আশ্রয় নিয়ে থাকেন। যা কখনো কাম্য নয়। এতে প্রচুর অর্থের অপচয় ঘটছে। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা বন্ধ না হলে জলাবদ্ধতা সংক্রান্ত কোনো প্রকল্পই কার্যকর হবে না। কারণ পাহাড়গুলো বালু মাটির হওয়ায় যখন কাটা হয় তখন একটু বৃষ্টি হলেই বালু শহরে নেমে আসে। খাল, ড্রেন সব ভরাট হয়ে যায়।

সূত্র জানায়, প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাস্তবায়ন মেয়াদ ধরা হয়। পরে দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এরই মধ্যে মহামারি কোভিড-১৯ এর কারণে মাঠপর্যায়ে প্রকল্পের ভৌত কাজ বাস্তবায়ন দেরি হয়ে যায়। এখন সংশোধনীতে দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। এখন ৫৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা কমিয়ে সংশোধিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫৬৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এটি বাস্তবায়ন করছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় পানি উন্নয়ন বোর্ড।

রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ : পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এর আগে কারিগরি কমিটির মাধ্যমে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (আরডিপিপি) কর্ণফুলী নদীর ডান তীর বরাবর (পতেঙ্গা এলাকায়) এই ওয়াল নির্মাণের কথা। এটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ১৯০ কিলোমিটার ধরা হয়। এছাড়া ২ দশমিক ৪০ কিলোমিটার রাস্তা উঁচুকরণ এবং একটি ব্রিজ সংস্কার করার কথা। প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এরই মধ্যে এই খাতে ২ দশমিক ৭০ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের জন্য অনুমোদিত ব্যয় ১১০ কোটি টাকার মধ্যে ১০৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অর্থাৎ মূল অনুমোদিত প্রাক্কলনের প্রায় শতভাগই ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত অগ্রগতি আংশিক উল্লেখ করা হয় সংশোধিনী প্রস্তাবে। পাশাপাশি এ খাতে প্রায় শতভাগ অর্থ ব্যয় হওয়ার পরও এই পর্যায়ে এসে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ কাজ শূন্য দশমিক ৫১০ কিলোমিটার কম করা হলেও এই খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করে ২৭৮ কোটি ৬৪ লাখ ১৪ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এই ব্যয় মূল অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে প্রায় ২৫৩ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি। কিন্তু সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নীতিমালা অনুযায়ী এটি নিয়মের ব্যত্যয়। নীতিমালায় বলা হয়েছে, অনেক সময় উন্নয়ন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত কোনো ক্রয় কার্যক্রমে প্যাকেজ বা লটের দরপত্রে উদ্ধৃত মূল্য এই প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট প্যাকেজ লটের অনুমোদিত প্রাক্কলিত ব্যয় অতিক্রম করতে পারে। সেক্ষেত্রে দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করার আগে আবশ্যিকভাবে প্রকল্পের সংশোধন কিংবা আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয়ের প্রস্তাব যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে আইনের সুস্পষ্ট ব্যত্যয় ঘটেছে এবং এ খাতে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে পিইসি সভায় প্রশ্নের মুখে পড়েন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

ফ্ল্যাডওয়াল নির্মাণ : মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) ফ্ল্যাডওয়াল নির্মাণ কাজ ১৮ দশমিক ৯৬৫ কিলোমিটারের জন্য ৮১০ কোটি ২৬ লাখ টাকার সংস্থান ছিল। প্রকল্পের ৫ বছর মেয়াদে মাত্র শূন্য দশমিক ৬০০ কিলোমিটার ফ্ল্যাডওয়াল নির্মাণের জন্য এর মধ্যেই ১৩৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এখন নতুন করে এই অংশের কাজের পরিমাণ কমিয়ে ৬ দশমিক ৮৮৫ কিলোমিটার ফ্ল্যাডওয়াল নির্মাণের জন্য ৪২৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা (প্রতি কিলোমিটার নির্মাণ ব্যয় ৬২ কোটি ১২ লাখ টাকা) ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। এই খাতে ইউনিট প্রতি ব্যয় ১৪৫ দশমিক ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রকল্পের এই পর্যায়ে এসে একটি চলমান কাজের বিপরীতে এত ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবের যৌক্তিকতা নিয়ে সভায় প্রশ্ন তোলা হয়। কেননা পরিকল্পনা কমিশনের মতে এটিও আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) ছায়েদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পটিতে যেসব অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে সেগুলো সংশোধন করতে বলা হয়েছে। তারা সংশোধিত ডিপিপিতে ব্যাখা দেবেন কেন এসব খাতে এরকম ঘটনা ঘটেছে।

সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ বলেন, প্রকল্প নিয়ে নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটেই চলছে। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির খুব কম। এ প্রকল্পে পরিকল্পনা কমিশন যেসব বিষয় তুলে ধরেছে এতে শুধু অনিয়ম বললে ভুল হবে, এখানে গুরুতর অনিয়ম হয়েছে। এ প্রস্তাবটি নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের পিইসি সভা করাই উচিত হয়নি। এসব ক্ষেত্রে কঠোর হতে না পারলে ভবিষ্যতে এরকম প্রস্তাব আসতেই থাকবে। পরিকল্পনা কমিশন যদি বিষয়টি নিয়ে কঠোর না হয় তাহলে এরকম ঘটনা প্রতিরোধ করা যাবে না।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রকল্পটির মেয়াদে ৩০ জুন শেষ হয়ে গেছে। সরকারের এ সংক্রান্ত নীতিমালা অনুসারে প্রকল্প সংশোধনের ক্ষেত্রে অনুমোদিত মেয়াদ শেষ হওয়ার অন্তত ৩ মাস আগে সংশোধনের জন্য প্রক্রিয়াকরণ করতে হয়। এছাড়া প্রকল্পের অনুমোদিত মেয়াদ পার হওয়ার পর প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলেও তা অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াকরণ না করার নিয়ম রয়েছে। এ কারণে প্রকল্পটি সংশোধন প্রক্রিয়াকরণে দেরি হওয়ার বিষয়ে পিইসি সভায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের পওর বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ যুগান্তরকে বলেন, এ প্রকল্পটি আমরা সরাসরি বাস্তবায়ন করছি না। এটি সেনাবাহিনীকে ডেলিগেট করে দেওয়া হয়েছে। এরপরও বলতে পারি এটি বাস্তবায়নে কোনো অনিয়মের ঘটনা ঘটেনি। আমরা এক বছর আগেই পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সেখান থেকেই পরিকল্পনা কমিশনে যেতে দেরি হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার সময় কোনো সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়নি। ফলে পরে এসে ডিজাইন পরিবর্তন করতে হয়েছে। রিটেইনিং ওয়াল করতে গিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বাধা ছিল। পরে তারা শর্ত দেয় যে রাস্তা উঁচু করতে হবে। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি। ফলে শুধু রিটেইনিং ওয়াল নয় এর সঙ্গে রাস্তা উঁচুকরণসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম যুক্ত থাকায় এত বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে। ফ্ল্যাডওয়াল বেশ কিছু জায়গায় আগেই করা আছে। আমরা এ প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু করব এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কিছুটা করবে। ফলে এই প্রকল্প থেকে ফ্ল্যাডওয়ালের কিছু কাজ বাদ দেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য সব বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলেছে পরিকল্পনা কমিশন। আমরা ব্যাখ্যার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

প্রকল্প পরিচালক কর্নেল মোহাম্মদ মহিউদ্দিন মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে কথা বলবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বা সংশ্লিষ্ট পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। কেননা এটা তাদের প্রকল্প। আমরা প্রকল্পের পরিকল্পনা এবং কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত নই। ডেলিগেটেড প্রকল্প হিসাবে সেনাবাহিনী এটির কাজ করছে শুধু। এর বেশি কিছু বলার দায়িত্বশীল আমি নই।

পরবর্তীতে তিনি ফোন করে বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিশন কি বলেছে সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করছি না, কাজের বিষয়ে কোনো কিছু জানার থাকলে প্রকল্প এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখতে পারেন।’

সূত্র জানায়, মূল অনুমোদিত প্রকল্পে ২৩টি রেগুলেটর নির্মাণের কথা থাকলেও তা কমিয়ে ২১টি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে এ খাতে অনুমোদিত ১৭৮ কোটি টাকার মধ্যে ১৫১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। এই অর্থে মাত্র ৩টি রেগুলেটরের কাজ শেষ করা হয়েছে। কিন্তু কাজ কমলেও এ খাতে এখন প্রস্তাব করা হয়েছে ২৮৮ কোটি ৩৯ লাখ টাক। যা মূল অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে ১৭৭ শতাংশ বেশি। এই অস্বাভাবিক ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, এভাবে ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে। এছাড়া আরও অনেক খাতের প্রস্তাবিত ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।