Image description

ঘুরে দাঁড়ানো চেষ্টার মধ্যেই পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরেও চলছে অস্থিরতা। শূণ্য পদ থাকার পরেও পদোন্নতি ও পদায়ন না হওয়ায় পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে চরম অসস্তোষ-হতাশা বিরাজ করছে। অন্তবর্তীকালিন সরকারের সময় দেশের সার্বিক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি যখন উন্নতির জন্য কাজ করছে, ঠিক তখনও পুলিশের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটসহ পুলিশের ১৯টি অতিরিক্ত আইজিপির পদ শূণ্য হয়ে পড়ে আছে। যথাসময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঠিক পদক্ষেপ না নেয়ায় পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে এ ক্ষোভ বিরাজ করছে। পুলিশ সদর দফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করলেও অনেকটাই অন্ধকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে করে পুলিশের সার্বিক কর্মকান্ডে গতি ফেরানোর সরকারের উদ্যোগ অনেকটাই ভেস্তে যেতে বসেছে।

 

প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসেও পুলিশ বাহিনীর ভেতরের অস্থিরতা পুরোপুরি কাটেনি। দূর হয়নি সংকটও। কিছুটা গতিশীল হলেও পদায়ন-বদলি, পদোন্নতি বা চাকরিচ্যুতি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিভক্তিসহ নানা ধরনের জটিলতা এখনো বিরাজ করছে রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা পুলিশ বিভাগে। এতে করে সারা দেশে নাগরিকসেবা, সামাজিক শৃঙ্খলা ও আইনি সুরক্ষার কাজটিও যথাযথভাবে হচ্ছে না। বরং কোথাও কোথাও পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেও যাচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকারকে সম্পূর্ণভাবে গতিশীল করতে হলে রাষ্ট্রের এই প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত সক্রিয় করতে হবে। যোগ্য ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে দ্রুত পদায়ন করতে হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অতিরিক্ত আইজিপি ইনকিলাবকে বলেন, পুলিশ সদর দফতরসহ অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার ১৯টি পদ শূণ্য রয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারনে যোগ্য কর্মকর্তা থাকার পরেও সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে গঠিত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) বৈঠক দীর্ঘদিন ধরে না হবার কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অনেকটাই নিস্ক্রিয়। ফলে পুলিশ পুন:গঠন ও সারাদেশের পুলিশ ইউনিটগুলোকে সক্রিয় করতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। শহীদদের রক্তের বিনিময়ে দেশে নতুন সরকার গঠন হলেও খুনের সাথে জড়িত শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়েই বৈঠক করছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ সদর দফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা। আ’লীগের ক্যাডারদের রেখে পুলিশ প্রশাসন সংস্কার করা সম্ভব নয়। অতিরিক্ত আইজিপি ও ডিআইজিদের পদোন্নতি দেয়া হলে দ্রুত অতিরিক্ত ডিআইজি, এসপি ও অতিরিক্ত এসপি পদে পদোন্নতি পাবেন যোগ্য-বঞ্চিত পুলিশ কর্মকর্তারা বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।

 

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে এখনও অনেক কর্মকর্তাই বহাল রয়েছেন। যারা জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি চালানো এবং হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত। একই সাথে একাধিক হত্যা মামলার আসামি হয়েও অনেক কর্মকর্তাই পুলিশ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের নানা পদে রয়েছেন। এসব কর্মকর্তারা একদিকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার করছেন পলাতক পুলিশ কর্মকর্তা এবং পতিত আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের কাছে, অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে থাকলেও দেশের সার্বিক আইন-শৃংখলা উন্নয়নে তেমন কোন ভূমিকা রাখছেন না। ফলে দেশের সার্বিক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি উন্নতির ক্ষেত্রে ধীরগতিতে কাজ করতে হচ্ছে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের।নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। যে কারণে পুলিশ সদর দফতরসহ পুলিশের বেশ কয়েকটি ইউনিট প্রধানের পদ এখনও শূণ্য রয়েছে। অতিরিক্ত আইজিপির ১৯টি পদ এবং ৩৫টি ডিআইজির পদসহ অনেক পদ এখনও শূণ্য রয়েছেন। পুলিশে যোগ্য, পেশাদার ও বঞ্চিত কর্মকর্তা থাকার পরেও যথাসময়ে পদোন্নতি আর পদায়ন না হওয়ায় অস্থিরতা বিরাজ করছে।


সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতন হলেও হত্যায় অভিযুক্ত ও ইন্ধনদাতা পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা সদর দফতরের বিশেষ মনিটরিং সেল থেকে সারাদেশে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ও নিপীড়নের আদেশ সমন্বয়ের কাজ করেছেন ফ্যাসিবাদের সেসব দোসররা পদায়ন পেয়ে এখনো বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপার, এসবি, সিআইডি, পুলিশ হেডকোয়ার্টারের বিভিন্ন শাখায় কর্মরত রয়েছেন। ফলে আওয়ামী লীগের আমলে বৈষম্যের শিকার পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো বঞ্চিত হচ্ছেন। এর ফলে পেশাদার, সৎ ও বঞ্চিত পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে পুলিশ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও তাদের কর্মকা-ে নানা অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনাও ফুটে উঠছে। পদায়ন, বদলিসংক্রান্ত বিষয়গুলো এখন জটিল আকার ধারণ করছে। কাকে কোথায় দায়িত্ব দিলে ভালো কাজ হবে সেটার দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তার মাঝে কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ বেশ ভালো উন্নতি করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখনো পুরোপুরি শৃঙ্খলা আনতে পারেনি। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। জনগণের জন্যই প্রকৃতপক্ষে পুলিশকে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করলে ভবিষ্যতে আবারও নাজেহাল হওয়ার শঙ্কা থাকবে।


পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমানে পুলিশ সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। পুলিশের শূণ্যপদগুলো পুরন করা হবে। আমরা আশাবাদি এ প্রক্রিয়া দ্রুততার সাথে সম্পন্ন হবে।

 

পুলিশের অনেক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে ইনকিলাবকে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতন হলেও হত্যায় অভিযুক্ত ও ইন্ধদাতা পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন।