যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে বাংলাদেশে যেকোনো সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এমন বাস্তবতায় দেশটির ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি সুযোগ হিসেবে দেখা হয়েছে ছয় মাস আগে। তবে ওয়াশিংটনে পালাবদলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান দল বিপুলভাবে ক্ষমতায় ফিরে আসায় দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা।
এই আলোচনা চলছে নানা প্রশ্ন সামনে রেখে—মার্কিনদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে দেশটির অন্যতম মিত্র ভারত প্রভাব খাটাতে পারবে কি না? ট্রাম্প কি বাংলাদেশকে ভারতের চোখে দেখবেন? নাকি বাংলাদেশ বিষয়ে কোনো প্রসঙ্গ তাঁর সামনে এলে নিজ দেশের চিরাচরিত বৈশ্বিক স্বার্থের দিকটি আগে বিবেচনায় নেবেন তিনি?
ওয়াশিংটন ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশকে যতটা না ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখবে, তার চেয়ে বেশি বিবেচনায় নেবে বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক।
ট্রাম্প নিজে ব্যবসায়ী, এমন বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী অবস্থান নেয়, তা তাঁর সরকারের অন্যতম বিবেচ্য হতে পারে, এমনটাও মনে করছেন কেউ কেউ।
ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান ৯ জানুয়ারি এক এক্স-পোস্টে বলেন, শেখ হাসিনার পতন দিল্লির প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে এসেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের বন্ধু খুব কম। দেশটি তাই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে চাইবে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেয়, তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের নজর থাকবে, এমনটা মনে করেন কুগেলম্যান।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ‘পদত্যাগ করে’ গত ৫ আগস্ট ভারতে আশ্রয় নেন।
২০২৪ সালে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের মান নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের অসন্তুষ্টি আছে, বিষয়টির উল্লেখ করে কুগেলম্যান বৈদেশিক নীতিবিষয়ক সাময়িকী ফরেন পলিসিতে এক প্রবন্ধে বলেন, ‘ট্রাম্প হয়তো বৃহৎ শক্তির প্রতিযোগিতা এবং বাণিজ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশকে দেখতে পারেন।’
এবারকার ট্রাম্প প্রশাসনের বাংলাদেশ নীতি কী হতে পারে, এমন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর গতকাল শনিবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশকে দেখবে প্রধানত তাদের এশিয়া নীতি এবং দ্বিতীয়ত দক্ষিণ এশিয়া নীতির আলোকে। আর বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের এত বেশি আগ্রহের বিষয় আছে যে তা ছাড়িয়ে বাংলাদেশের প্রতি তাদের আগ্রহী হওয়ার সম্ভাবনা কম।
বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে প্রভাবিত করতে পারে কি না, এ বিষয়ে হুমায়ুন কবীর বলেন, ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে বাংলাদেশের ওপর কিছু বিষয়ে চাপ তৈরি করতে চাইতে পারে। কিন্তু ভারত নিয়েও ব্যক্তি হিসেবে ট্রাম্পের ও রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব হিসাব-নিকাশ আছে। ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত কী বলে, তার চেয়ে ঢাকায় নিজেদের রাষ্ট্রদূত ও মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ কী প্রতিবেদন দেয়, তার ওপর বেশি নির্ভর করবে।
হুমায়ুন কবির মনে করেন, নতুন মার্কিন প্রশাসন বরাবরের মতো একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফেরায় জোর দেবে। দ্বিতীয়ত, এখানকার মানবাধিকার পরিস্থিতি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অবস্থার ওপর নজর রাখবে তারা। আর তৃতীয়ত, বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হচ্ছে, তার ওপরও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব নজর রাখবে। এই কয়েকটি বিষয়ের ওপর ঠিক হবে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সরকারের সম্পর্ক কেমন যাবে।
ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটিও বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। দিল্লিভিত্তিক অনলাইন ডব্লিউআইওএনকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত যত দ্রুত সম্ভব, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেখতে চায়; যা বাংলাদেশের জন্য নতুন অধ্যায় শুরু করতে সহায়ক হতে পারে। গত বৃহস্পতিবার সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হয়।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও দলটির নেতা-কর্মীদের একাংশ অবশ্য মনে করছে, নতুন মার্কিন প্রশাসন কী কৌশল নেবে, তার ওপর ইউনূস সরকারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
শেখ হাসিনা সরকারের সর্বশেষ শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আগামী মাসগুলোয় বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ট্রাম্প প্রশাসনের মনোভাবের ওপর।’ গত শুক্রবার এ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়।
নওফেলের এই মন্তব্যকে স্থানীয় এক কূটনৈতিক বিশ্লেষক ‘দুর্ভাগ্যজনক’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের পরিবর্তে বিদেশিদের কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে থাকে। বর্তমানে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কোনো প্রকাশ্য অবস্থান নেই, এটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে নওফেল দেশের ভেতর কর্মীদের চাঙা রাখার জন্য ট্রাম্পের নাম ব্যবহার করতে পারেন।
বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা ওয়াশিংটন থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলছেন, ট্রাম্প সরকার দেশটির পররাষ্ট্র বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন দেশে তাদের অন্তত ৩০ রাষ্ট্রদূতের নিয়োগ বাতিল করছে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে যাওয়া পররাষ্ট্র বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মার্শা বার্নিকাটকে এরই মধ্যে সরে যেতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ জো বাইডেনের নিয়োগ দেওয়া ডেভিড মিলার রাষ্ট্রদূত হিসেবে ঢাকায় আসা না-ও হতে পারে, এটাও অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায় অবসরে যাওয়া প্রবীণ কূটনীতিক ট্র্যাসি জেকবসনকে অন্তর্বর্তী ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত হিসেবে ঢাকা পাঠানোয়।
স্থানীয় কূটনীতিকেরা মনে করছেন, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশে নতুন রাষ্ট্রদূত পাঠাতে ছয় মাস সময় নিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশে নির্বাচন, সংস্কারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের রুটিন ইস্যুগুলো সামনে আনবে। ট্র্যাসি জেকবসন তেমন আভাস দিতে শুরু করেছেন।
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস গত বৃহস্পতিবার এক ফেসবুক পোস্টে বলেছে, ট্র্যাসি জেকবসন তাঁর প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সঙ্গে আলাপে শ্রমিকের অধিকার, বিচার বিভাগের সংস্কার ও সন্ত্রাসবাদ বিরোধিতার প্রসঙ্গ তুলেছেন।
ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে বাংলাদেশের ওপর কিছু চাপ তৈরি করতে চাইতে পারে। কিন্তু ভারত নিয়েও ব্যক্তি হিসেবে ট্রাম্পের ও রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব হিসাব-নিকাশ আছে।