যুক্তরাজ্য সরকারের সিটি মিনিস্টার ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে নেমেছে বাংলাদেশের চারটি সংস্থা। এগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। দেশের কয়েকটি ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা টাকার একটি অংশ শেখ রেহানার মাধ্যমে টিউলিপের পকেটে গেছে বা ওই টাকার সুবিধা তিনি ভোগ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের টাকার সুবিধাও হাতবদল হয়ে টিউলিপ পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া ব্রিটেনেও তার (টিউলিপ) বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতার কাছ থেকে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট উপহার নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগে যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকেও তদন্ত চলছে। বাংলাদেশেও অভিযোগগুলোর তদন্ত হচ্ছে।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরে দেশের কয়েকটি ব্যাংকে বড় বড় ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ছোট ছোট ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে অনেক। এসব ঋণ জালিয়াতির টাকার একটি অংশের সুবিধাভোগী ছিলেন শেখ রেহানা। বেসিক ব্যাংক জালিয়াতির প্রধান নায়ক ছিলেন ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই তাকে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। তারপরই শুরু হয় ব্যাংক লুটের প্রক্রিয়া। তিন বছরের মধ্যেই ব্যাংক লুট হয়ে যায়। ওই সময়ে ব্যাংকটি থেকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। যেগুলো এখন খেলাপি। বেসিকের মোট ঋণের ৬৫ শতাংশই খেলাপি, যার পরিমাণ সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলে ওইসব পণ্য দেশে না এনে আমদানির আড়ালে বেশ কিছু টাকা পাচার করা হয়েছে। ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তদন্তে এলসি খুলে পণ্য দেশে না এনে ১৭৫ কোটি টাকা পাচার করার তথ্য পাওয়া গেছে। এর বাইরে জালিয়াতির মাধ্যমে আরও টাকা পাচার করা হয়েছে। শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর সঙ্গে শেখ রেহানার একটি যোগাযোগ ছিল বলে জানা গেছে। এর মাধ্যমে বেসিকের ঋণ জালিয়াতির সুবিধাভোগীও ছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। এছাড়া এস আলম গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে পাচার করা টাকার একটি অংশের সুবিধাভোগী হয়েছেন শেখ রেহানা।
সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ে আল আমরিন গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় শতকোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। ঢাকার পাশেই সোনারগাঁয়ে এর কারখানা রয়েছে বলে সোনালী ব্যাংকে দেওয়া কাগজপত্রে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু ওই স্থানে গ্রুপের ছোট একটি ভবন ছাড়া অন্য কিছুই নেই। তারপরও ব্যাংক ওই গ্রুপের নামে শতকোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ওই ঋণের পুরোটাই এখন খেলাপি। খেলাপি হওয়ার কারণে ব্যাংক ওই গ্রুপের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছে। এক পর্যায়ে গ্রুপটিকে ঋণ দিতে সোনালী ব্যাংক অনীহা প্রকাশ করে। পরে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ের ঋণ বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত এক উপমহাব্যবস্থাপককে (ডিজিএম) শেখ রেহানা ফোন করেছিলেন ওই গ্রুপকে ঋণ দেওয়ার জন্য। এরপর ব্যাংক কোনো বাছবিচার না করেই তাদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণের জোগান দিয়েছে। এই ঋণ জালিয়াতির টাকার একটি অংশের সুবিধাভোগী ছিলেন শেখ রেহানা।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্যদের সহায়তাকারী ১০টি শিল্প গ্রুপের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। এসব তদন্তে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার পরিবারের অনেকের এবং তার বোন শেখ রেহানার নাম উঠে আসছে। পাশাপাশি শেখ রেহানার মেয়ে সদ্য পদত্যাগী যুক্তরাজ্যে লেবার পার্টির মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের নামও আসছে।
এদিকে বাংলাদেশে ৯টি বড় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে শেখ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। তাতে টিউলিপের নামও উঠে আসে। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে।
জানা গেছে, ২০১৩ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। সেই চুক্তিতে টিউলিপ সিদ্দিক সহযোগিতা করেন। চুক্তিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ব্যয় ১০০ কোটি ডলার বেশি দেখানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে।
এসব প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে নানাভাবে পাচার করা টাকার সুবিধাভোগী হয়েছে সাবেক ব্রিটিশ মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক। বিশেষ করে তার খালা ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলেই ওইসব কর্মকাণ্ড ঘটেছে। এসব দুর্নীতির অভিযোগে টিউলিপকে ব্রিটেনে লেবার পার্টি সরকারের মন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে শেখ পরিবারের দুর্নীতির তদন্ত কাজ দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে ১১টি তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। এসব দলের তদন্ত কাজ সমন্বয় করছে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)। দুদকের সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং সিআইডিও আছে। তারা একে অপরের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে তদন্ত কাজ পরিচালনা করবে। তদন্ত দলকে দেশে প্রচলিত আইন-কানুন ও বিধিবিধান মেনে তদন্ত করতে বলা হয়েছে। যাতে তদন্ত প্রতিবেদনটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের হয়।
তদন্তের স্বার্থে ইতোমধ্যে বিএফআইইউ থেকে শেখ পরিবারের সাত সদস্যের নামে দেশের পাশাপাশি বিদেশে থাকা সম্পদের তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে টিউলিপের নামও রয়েছে। ওইসব তথ্য পেলে বিদেশে আরও তদন্ত করা হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের সহায়তা চাওয়া হবে।
এদিকে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বিএফআইইউর একটি সমঝোতা স্মারক চুক্তি রয়েছে। এর আওতায়ও বিএফআইইউ যুক্তরাজ্যের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের কাছে তথ্য চাওয়ার সুযোগ পাবে।
সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের আলোকে প্রয়োজন হলে টিউলিপ বা শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে যুক্তরাজ্যে থাকা সম্পদের বিষয়েও দেশটির আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের কাছে তথ্য চাওয়া হবে।
টিউলিপের দুর্নীতির বিষয়ে যুক্তরাজ্য এবং বাংলাদেশে তদন্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে তদন্ত শেষ হলে দুই দেশ যৌথভাবে আরও বিশদ তদন্ত করতে পারে। সেজন্য দুই দেশকে তদন্ত প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হবে। এই প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনে বাংলাদেশের তদন্ত প্রতিবেদন যুক্তরাজ্য তদন্ত সংস্থার কাছে পাঠানো হবে। যাতে তদন্ত কাজটি আন্তর্জাতিক মানের, নিখুঁত ও পরিপূর্ণ হয়।
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে শেখ হাসিনা পরিবার ১০টি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপকে দেশে নানা ধরনের জালিয়াতির সুযোগ দিয়েছে। এর মাধ্যমে গ্রুপগুলো অর্থ আত্মসাৎ করে সেগুলো বিদেশে পাচার করেছে। পাচার করা অর্থের একটি অংশের সুবিধাভোগী হয়েছেন শেখ পরিবারের সদস্যরা। এ কারণে ১০টি বড় শিল্প গ্রুপকেও তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে। গ্রুপগুলো হচ্ছে, সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আরামিট গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, জেমকন গ্রুপ ও নাবিল গ্রুপ।