Image description

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত দুই দশকে একদিনের জন্যও সচিব ছাড়া না থাকলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে ২১ দিন এ পদে নিয়মিত কোনো কর্মকর্তা না থাকার রেকর্ড হয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ইতিহাসে অবসরে যাওয়ার ৮-৯ বছর পর কোনো কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম সচিব তো বটেই, দ্বিতীয় সচিবও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আছেন।

চুক্তিভিত্তিক পদে নজিরবিহীন বদলি

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া সচিবরা নির্দিষ্ট পদেই তার মেয়াদ শেষ করেন। এটাই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের রীতি। এখন চুক্তিভিত্তিক সচিবদের নজিরবিহীনভাবে বদলি করা হচ্ছে।

বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়োগের প্রয়োজন হলেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই উদ্দেশ্য পূরণ হলে তাকে বিদায় করা হয় বা প্রয়োজনে চুক্তি বাড়ানোও হয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে গুরুত্বহীন পদে কোন আইন ও বিধিতে বদলি করা হচ্ছে? এইসব বদলিতে জনস্বার্থ কোথায়?

প্রশ্নটি রাখাই যেত জনপ্রশাসন সচিবের কাছে। বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করলাম, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া জনপ্রশাসন সচিব নিজেই বদলি কবুল করে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হয়েছেন। এখানেও হয়েছে নতুন রেকর্ড।

গত দুই দশকের মধ্যে এভাবে জনপ্রশাসন সচিবকে গুরুত্বহীন পদে বদলির রেকর্ড নেই। ফলে তিনি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার যোগ্যতাটাও হারিয়েছেন।

শুধু উত্তর দেওয়ার যোগ্যতাই হারাননি, সদ্য সাবেক জনপ্রশাসন সচিব তার পদের গুরুত্বকেও খাটো করেছেন। প্রশাসনের তৃতীয় শীর্ষ পদ থেকে নামসর্বস্ব জায়গায় পদায়নের পরও সরকারে ঝুলে আছেন। এমন ব্যক্তিকে মানসম্পন্ন কর্মকর্তার তকমা দেওয়া যায় কি?

একই পথে হেঁটেছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া সাবেক স্বাস্থ্য সচিব, সাবেক শিক্ষা সচিবসহ কয়েকজন কর্মকর্তা। তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরও মেরুদণ্ড সোজা করে সরকারি সুবিধাগুলো ত্যাগ করতে পারছেন না। এর থেকেই কী প্রমাণ হয় না যে, প্রশাসনকে নেতৃত্ব দিতে মানসম্পন্ন কর্মকর্তাদের বাছাই করতে পারেনি সরকার অন্তর্বর্তী?

সরকার প্রধান হয়তো সব কর্মকর্তাদের সরাসরি চিনতেন না, চেনার কথাও না। তাই বলে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার যোগ্য পরামর্শকও ছিলেন না? তারা কি সময়োপযোগী পরামর্শ দিতে পারেননি? নাকি প্রশাসনে সাবেক ও বর্তমানদের মধ্যে সেই মানের কর্মকর্তা নেই?

অগুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি হওয়া চুক্তিভিত্তিক সচিবরা এক-এগারোর সরকারের সময় এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর রহমানের দেখানো পথ অবলম্বন করলে ব্যক্তিগতভাবে উজ্জ্বল হওয়ার সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারের মুখ উজ্জ্বল হতো।

বদিউর রহমান উল্লিখিতদের চেয়েও জুনিয়র কর্মকর্তা। তিনি এক-এগারোর সরকারের সময় (২০০৭ সালে) নিয়মিত চাকরি ১ বছর ৩ তিন মাস বাকি থাকার পরও এনবিআর থেকে খাদ্য সচিব হিসেবে বদলির প্রতিবাদে স্বেচ্ছা অবসরে গিয়ে ইতিহাস তৈরি করেছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের চুক্তিভিত্তিক সচিবদের অনেকে অবসরের এক দশক পর নিয়োগ পেয়েও পদের মায়া ত্যাগ করতে পারছেন না। উল্টো অনেকে বিশ্বব্যাংকে যুগ্মসচিব অবস্থানের একটি পদে যাওয়ার জন্য তদবির করছেন। এমন কর্মকর্তাদের কাছে জুনিয়ররা কী শিখবেন? এমন মানের কর্মকর্তারা একটি ভঙ্গুর প্রশাসনকে ঠিক করবেন? এ কারণেই হয়তো প্রশাসনে প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি বা হচ্ছে না।

ডিসি নিয়ে বহুমুখী জটিলতা

চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগের দুটি জেলার ডিসি কর্মস্থলে যোগদানের পরপরই বেপরোয়া আচরণের তথ্য সরকারের কাছে ছিল। তারপরও তাদের প্রত্যাহার করতে এক বছর সময় নেওয়া হলো কেন?

এখানেই শেষ নয়। ২২ দিন হয়ে গেলেও দেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ জেলা সদর চট্টগ্রামে এখনো ডিসি নিয়োগ দিতে পারেনি। পুরনো ডিসি প্রত্যাহারের দিনই নতুন ডিসির প্রজ্ঞাপন হয়েছে। তারপর এতদিন কেটে গেলেও নতুন ডিসি চট্টগ্রামে যোগ দেননি। যদি এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়, সেক্ষেত্রে কেন প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করা হয়নি বা হচ্ছে না?

কক্সবাজারের ডিসি নিয়োগ হওয়ার পরও নাটক কম হয়নি। উচ্চমহলে দ্বন্দ্বের কারণে প্রথমে তাকে স্টেশনে যেতে মানা করা হয়। ৮ দিন পর আবার তাকেই পাঠানো হয়। এসবের আড়ালে প্রশাসনে কী কী আলোচনা হয় সেগুলো আক্ষরিক প্রমাণের অভাবে গণমাধ্যমে না এলেও প্রশাসনের অভ্যন্তরে ভালো বার্তা যায় কি?

এদিকে ২০ জন ডিসি যুগ্মসচিব পদোন্নতি পাওয়ার ৭ মাস পরও মাঠে কাজ করছেন। হাজারের মতো যুগ্মসচিব প্রশাসনে থাকার পরও নতুন পদোন্নতি প্রয়োজন ছিল না। তারপরও কেন পদোন্নতি দেওয়া হলো? সরকার এদেরকে নির্বাচন পর্যন্ত মাঠে রাখতে চাইলে অবশ্য প্রশাসনে নতুন রেকর্ড গড়ার সুযোগ হবে। সরকার কী সেটাই চাইছে?

নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে ২০ জনের বেশি সাবেক ডিসিকে বাধ্যতামূলক অবসরসহ অর্ধশতাধিক সাবেক ডিসিকে ওএসডি বা অগুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি করা হয়েছে। নির্বাচনে কী শুধু কি এই ডিসিরাই প্রশ্নবিদ্ধ ছিলেন?

তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্বশীল কাদের কী ভূমিকা ছিল, তা নির্ধারণে গত ২৭ জুন সরকার একটি কমিশন গঠন করলো। একই অপরাধে যাদের বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে তাদের বিচার আগেই কীভাবে হলো, কোন মানদণ্ডে?

প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচনগুলোর জন্য প্রথমত দায় নির্বাচন কমিশন ও কমিশন সচিবালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের। এছাড়া মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিবরা মূলত দায়ী।

২০২৪ সালে ডিসিরা যে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের অধীনে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের কারণে শাস্তির মুখে পড়ছেন, সরকার সেই মন্ত্রিপরিষদ সচিবের চুক্তিটি পর্যন্ত বাতিল করেনি। উল্টো প্রশংসাপত্রসহ স্বাভাবিক বিদায় দিয়েছে। কী অদ্ভুত বিচার!

নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের কারণে সিভিল প্রশাসনের অনেকে বিচার ছাড়াই শাস্তি পেল। নির্বাচনে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার কর্মকর্তারাও তো দায়িত্বে থাকেন। তাদের কী এভাবে শাস্তি দিতে পেরেছে সরকার? বলছি না তাদেরকেও বিচারহীন শাস্তি দিন, বলছি সবার জন্য সমান ব্যবস্থা কেন নেওয়া হচ্ছে না?

সুবিচারের বার্তা প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে কী প্রশাসনে শৃঙ্খলা আনা আদৌ সম্ভব?

জনপ্রশাসন অভিভাবকহীন কেন?

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জন্য পৃথক উপদেষ্টা নেই। প্রথম দিকে এক উপদেষ্টা অনানুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পালন করলেও তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর পরিস্থিতির বড় উন্নতি হয়নি।

গত ২০ জানুয়ারি অর্থ উপদেষ্টার সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। নাহিদ ইসলামের পর এই কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন মাহফুজ আলম। গত ২৭ আগস্ট এই কমিটির নতুন সদস্য সচিব করা হয়েছে পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসানকে। একইদিনে মুখ্য সচিবকে নতুন সদস্য যুক্ত করলেও মাস না পার হতেই তাকে এ কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

আমলাতন্ত্র পরিচালনায় কমিটির এসব যোগ-বিয়োগ কী স্বাভাবিক বার্তা দেয়?

কমিটি দিয়ে কী প্রশাসনের নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নের প্রাত্যহিক কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়? জনপ্রশাসনে পৃথক উপদেষ্টা নিয়োগে সমস্যা কোথায়?

নাকি সরকার এভাবেই চলতে চায়?