
আওয়ামী আমলে ঢাকার সিএমএম থাকাবস্থায় রেজাউল করিমের ন্যক্কারজনক দলবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা কেউ কোনোদিন ভুলতে পারবে না। তিনি যেখানেই কর্মরত ছিলেন, সেখানেই আইন ও বিচার অঙ্গনের অনেকেই তার দ্বারা হেনস্তার শিকার হয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগে বহুল আলোচিত সেই ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) রেজাউল করিম চৌধুরীকে অবশেষে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর আইন ও বিচার বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে এই আদেশ জারি করা হয়, যা সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে গৃহীত হয়।
সোমবার আইন অঙ্গনে এ খবর চাউর হওয়ার পর সবার মধ্যে একধরনের স্বস্তি নেমে আসে। বিশেষ করে তার দ্বারা যারা নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন, তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়।
এ বিষয়ে বিচার ও আইনসংশ্লিষ্ট কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যুগান্তরকে জানান, এই দুর্নীতিবাজ বিচারকের কারণে জুডিশিয়াল ক্যাডারের সুনামও ক্ষুণ্ন হয়েছে। বলতে গেলে তিনি বিচারক হয়েও পদে পদে অবিচার করেছেন। নিজেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছের লোক পরিচয় দিয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আদালতকে বানিয়েছিলেন দুর্নীতির আঁতুড়ঘর। তার কথামতো কাজ না করলেই রোষানলে পড়তে হতো অধীনস্থ বিচারকদের।
আইন ও বিচার বিভাগের সচিব লিয়াকত আলী মোল্লা স্বাক্ষরিত ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত ঢাকার সাবেক চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সুপ্রিম জুডিশিয়াল সার্ভিসের শৃঙ্খলা বিধিমালা অনুযায়ী অসদাচরণের অভিযোগে মামলা রুজু করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা যুক্তিযুক্ত মর্মে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে বাংলাদেশ সুপ্রিম জুডিশিয়াল সার্ভিসের শৃঙ্খলা বিধিমালা-২০১৭-এর বিধি ১১ অনুযায়ী রেজাউল করিম চৌধুরীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।’ ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতনের পর তাকে কুমিল্লায় নারী ও শিশু আদালতে বদলি এবং পরবর্তী সময়ে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়।
এর আগে ঘুস গ্রহণ, জামিন বাণিজ্য, মামলায় প্রভাব খাটিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াসহ বহুবিধ অপরাধের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করে দুদক।
দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার তৃতীয় মেয়াদে গঠিত মন্ত্রিসভায় আনিসুল হক আইনমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই বিচার বিভাগে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাত্রা বাড়তে থাকে। ওই সময় থেকেই মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তাসহ অধস্তন আদালতের একাধিক বিচারক মন্ত্রীর আস্থাভাজন হয়ে পড়েন। এরপর আস্থাভাজনসংশ্লিষ্ট বিচারকরা নানা ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিলেন রেজাউল করিম চৌধুরী।
এছাড়া ওই সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এক মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দিতে এলে তাকে বেআইনিভাবে ‘অভ্যর্থনা’ জানান রেজাউল করিমসহ কয়েকজন বিচারক। তারা খাসকামরা থেকে বের হয়ে জয়কে গাড়ি থেকে নামিয়ে আদালত কক্ষে নিয়ে যান এবং সাক্ষ্য শেষে তাকে আবার গাড়িতে তুলে দেন। বিষয়টি নিয়ে ওই সময় আদালতপাড়ায় ব্যাপক সমালোচনা হয়।
সাক্ষী যত বড় ভিআইপি হোক না কেন, কোনো বিচারক এভাবে প্রটোকল দিতে পারেন না। মূলত ওইসময় ব্যক্তিগত সুবিধা নিতে দলীয় ক্যাডারের মতো তারা এমনটি করেছিলেন। যুগান্তরের কাছে এমন অভিমত প্রকাশ করেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম।
অভিযোগ রয়েছে, রেজাউল করিম চৌধুরী আওয়ামী লীগ আমলে ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে আদালতকে বানিয়েছিলেন দুর্নীতির আঁতুড়ঘর। আওয়ামী সরকারের মদদপুষ্ট এই বিচারক আইনের কোনো তোয়াক্কা না করে বিরোধী দল দমনে ছিলেন অতি-উৎসাহী। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মৃত ব্যক্তিকে সাজা প্রদান, নির্বাচনের আগে ১৬১টি রাজনৈতিক মামলায় শুধু পুলিশের সাক্ষ্য নিয়ে বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের সাজা দেওয়া হয়।
এছাড়া অর্থের বিনিময়ে মামলা থেকে অব্যাহতি ও জামিন প্রদান, ডিজিএফআই-এর ভয় দেখিয়ে অধীনস্থ বিচারকদের জামিন দিতে বাধ্য করা হতো। তার কথামতো কাজ না করলে নেমে আসত নানা ধরনের হয়রানি। অনেককে শাস্তিমূলক বদলি করার ভয়ও দেখাতেন। এমনকি অকথ্য ভাষায় গালগালও করতেন। আবার কাউকে শায়েস্তা করতে মন্ত্রণালয়ে মিথ্যা অভিযোগপত্র পাঠিয়ে সেটি নথিতে পুটআপ করাতেন। এসব কারণে অনেক সৎ, যোগ্য ও দক্ষ বিচারকরা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারতেন না। হয়রানি এড়াতে এবং চাকরি রক্ষার স্বার্থে তারা অনেকটা বিবেকের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করতে বাধ্য হতেন।
সূত্র জানায়, বহুল আলোচিত এই বিচারক এতটাই অর্থলোভী ছিলেন যে তিনি মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতে আদালতের নিলাম সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি তার সুবিধামতো গোপনে নিলাম ডেকে ফায়দা নিতেন। ওই সময় এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সিএমএম কোর্টের অফিস স্টাফরাও ভয়ে কিছু বলতে পারতেন না।
সূত্র মনে করে, দুদুক এ সংক্রান্ত নথিপত্র অনুসন্ধান করলে পদে পদে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে।
এছাড়াও বিচারক রেজাউল করিম ক্ষমতার অপব্যবহার করে ডিবির হেফাজতে থাকা মামলার আলামত হিসাবে জব্দকৃত একটি ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি ও অন্য একটি যানবাহন অবৈধভাবে নিজের হেফাজতে নিয়ে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি হাইকোর্টের আদেশও অমান্য করেন। অপরদিকে দলীয় পৃষ্ঠপোষক বিচারক হিসাবে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে পূর্বাচলে সাত কাঠার প্লট পেতে সক্ষম হন। তার সর্বোচ্চ ৫ কাঠা পাওয়ার কথা থাকলেও তিনি ৭ কাঠা প্লট অনায়াসে পেয়ে যান। তার লোভের এখানেই শেষ নয়। এই বিচারক একটি আবাসন ব্যবসায়ী গ্রুপের মামলায় বিশেষ সুবিধা দিয়ে এর বিনিময়ে রাজধানীতে পাঁচ কাঠার মূল্যবান প্লট নিজের নামে বরাদ্দ নেন।
এদিকে তিনি নিজ জেলা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিলাসবহুল তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এছাড়া চট্টগ্রামে শহরে জাকির হোসেন রোডের ইয়াকুব সেন্টারে বড় পরিসরের ফ্ল্যাট কিনেছেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে রেজাউল করিম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এসব অভিযোগ দুদক তদন্ত করছে। তারা দেখবে আমার কোনো দোষ আছে কি-না। দুর্নীতির বিষয়ে আমার বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছিল সেখানে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি। যা মীমাংসিত তা নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
সজীব ওয়াজেদ জয়কে প্রটোকল দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, তিনি যেদিন আদালতে আসেন সেদিন এসএসএফ পুরো আদালত কন্ট্রোলে নিয়ে ফেলে। তখন আমি তাদের বলি যেন সবকিছু সফটলি করে। বিচার কাজে যেন বিঘ্ন না ঘটে। এ সময় আমি আমার করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন তিনি (জয়) আসেন। তখন তো আমি না গিয়ে পারি না। এ সময়ের জয় আর সে সময়ের জয় তো এক ছিল না।