
যুগ ধরে কাজ চলা বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প অবশেষে ব্যর্থ প্রকল্পে রূপ নিয়েছে। ঢাকা লাইন নামে নিজেদের কোম্পানির বাস চালু করার কথা থাকলেও সেটি হচ্ছে না। বিআরটি প্রকল্প আর সামনে এগুচ্ছে না। এটি আর এগিয়ে নেয়া হবে না। এখানেই শেষ করা হবে। এটি সাধারণ চার লেনের সড়ক হিসেবে চালু করা হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
দায়িত্বশীলদের গাফিলতিতে বিআরটি প্রকল্পটি মৃত্যুফাঁদ হিসেবে উপাধি পায়। প্রকল্পের অব্যবস্থাপনায় প্রাণ হারায় সাধারণ মানুষ। বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণ প্রকল্পের গার্ডারের নিচে চাপা পড়ে একই দিন নিহত হন ৫ জন। এছাড়াও প্রকল্পের কাজ চলার সময় এ পর্যন্ত ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গাফিলতি, অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তাহীনতাই মূলকারণ বলছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।
প্রধান উপদেষ্টার সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলওয়ে বিষয়ক বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে এখনো কোনো ট্রান্সপোর্ট মাস্টারপ্ল্যান নেই। আলাদা আলাদা সংস্থা তাদের মতো করে পরিকল্পনা তৈরি করে। ফলে সমন্বয়ের অভাব দেখা দেয়। আমরা এখন সড়ক, রেল ও নৌ এই তিন খাতের জন্য একটি সমন্বিত ট্রান্সপোর্ট মাস্টারপ্ল্যান করছি। এর খসড়া চূড়ান্ত হয়ে গেছে। বিআরটি প্রকল্প নিয়ে তিনি বলেন, এটি আর এগিয়ে নেওয়া হবে না। এখানেই শেষ করা হবে। এটি সাধারণ চার লেনের সড়ক হিসেবে চালু করা হবে।
ইতোমধ্যেই সাধারণ সড়কের মতো বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাস গুলিস্তান থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে বিমানবন্দর ও বিআরটি লাইনে বাস সেবা চালু করে। বিআরটি প্রকল্পের জন্য ১৩৭ বাস কেনার কথা ছিলো। তবে বাস কেনার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। একবার দরপত্র আহ্বান করা হলেও সেটি বাতিল হয়। ২০১২ সালে প্রকল্প নেওয়া হলেও কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। ছয়বার মেয়াদ বাড়িয়ে এই শেষ করার নাম নেই। পরিকল্পনায় বড় ত্রুটি থাকায় প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই একে সিক প্রজেক্ট আখ্যা দেন।
যানজট কমানোর জন্য প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হলেও এ প্রকল্পের কাজের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই সড়কটিতে যানজটে ক্ষুব্ধ স্থানীয় লোকজন। এরইমধ্যে এই ফ্লাইওভার অংশের সড়কে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠে। যার কারণে বিআরটির উড়ালপথেও দেখা দিচ্ছে যাত্রী ভোগান্তি। এই পথে রাস্তা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার কথা থাকলেও দীর্ঘদিন ময়লা পরিস্কার না করার কারণে বিভিন্ন স্থানে ময়লা-অবর্জনা দেখা যায়। বিআরটি প্রকল্পের অসাধু কর্মকর্তারা অর্থ আত্মসাৎ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সড়কে নির্মাণকাজের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন মূল্যবান জিনিসপত্র নষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় অবকাঠামো ভেঙে যাচ্ছে। বিগত সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও কমিশন-বাণিজ্যের খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। প্রতিদিন রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ এবং ঢাকা বিভাগের অন্তত ২৩ জেলার কয়েক লাখ মানুষ এ সড়কে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে বসে থাকা, যানবাহনের ক্ষতি, অসুস্থ রোগী নিয়ে সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে না। অনেক স্থানে মালপত্র চুরি হয়ে গেছে, নষ্ট হচ্ছে। বিআরটি স্টেশনগুলো মাদকসেবী, ভবঘুরে, ভিক্ষুক আর ছিনতাইকারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি প্রায় ৭৮ শতাংশ। বাকি কাজ শেষ করতে মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়িয়ে প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয় পরিকল্পনা কমিশনে। ২০২৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর কাজ শেষ হওয়ার কথা। একই সঙ্গে ব্যয় বেড়ে ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সংশোধনী প্রস্তাবটি একনেকে অনুমোদন পায়নি। এরই মধ্যে ২০ কিলোমিটার সড়কে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি হলে তা অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। কাজ কীভাবে শেষ করা যায় সেটা অনুসন্ধানে সরকারকে সেই পথ বের করা উচিত। কিন্তু কাজ পুরোপুরি বন্ধ রাখায় জনগণের দুর্ভোগ আরো দীর্ঘ হচ্ছে।
ঢাকা থেকে গাজীপুর পথে চলাচলকারী কয়েকজন যাত্রী বলেন, আমরা নিরুপায়, যানজটের ভয়ে আমরা ঝুঁকি জেনেও এখান দিয়ে যাতায়াত করি। বিআরটি প্রকল্প হাতে নেয়ার পর থেকে এই রুটে সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তি শুরু হয়েছে। এক যুগেও এই পথের কাজ শেষ হয়নি। ভোগান্তি পোহাতে পোহাতে আমরা অতিষ্ঠ।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. শামছুল হক বলেন, রাজধানীর একটি চলাচলরত রাস্তায় এভাবে এতো বড় প্রকল্পের কাজ হচ্ছে কোন প্রকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া। এতে নিরিহ মানুষ শিকার হচ্ছে। এই প্রকল্প করার আগে বিআরটির দর্শন অনুসরণ করা হয়নি। এসব কারণেই এখন আমাদের উন্নয়ন যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে। প্রকল্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল বলেই দুর্ঘটনা ঘটে। বিআরটি একটি খন্ডিত প্রকল্প। দীর্ঘসময় ও অতিরিক্ত খরচে বিআরটি প্রকল্প রেকর্ড করেছে।