Image description
জয়ের ব্যাপারে ছাত্রদল-শিবির দুই প্যানেলই আশাবাদী নিরাপত্তার চাদরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদের বহুল প্রতীক্ষিত নির্বাচন আগামীকাল বুধবার। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনকে ঘিরে পাহাড়ঘেরা সবুজ ক্যাম্পাসে এখন উৎসবের আমেজ। প্রার্থীরা গতকাল সোমবার তাদের নির্বাচনী প্রচার শেষ করেছেন।

ছাত্রদল সমর্থিত সাজ্জাদ-শাফায়েত-তৌফিক প্যানেলের প্রার্থীরা ব্যাপক প্রচার চালিয়েছেন। শিবির সমর্থিত সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোটের ইবরাহীম-সাইফ-সাজ্জাদ প্যানেলের প্রার্থীরাও প্রচারে দিনভর ছিলেন ব্যস্ত। ভোটের প্রচারের শেষ দিনে পুরো ক্যাম্পাস ছিল উৎসবমুখর। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ক্যাম্পাসে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি। প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করলেও বড় ধরনের কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি। এর ফলে নির্বাচনও শান্তিপূর্ণ হবে এমন প্রত্যাশা শিক্ষার্থীদের। চাকসুর নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচন হবে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ। নির্বাচনকে ঘিরে ক্যাম্পাসকে নিরাপত্তা চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে। আজ থেকে পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারবেন না। ভোটের দিনও কেবল পরিচয়পত্র নিয়েই ভোটকেন্দ্রে যাওয়া যাবে।

এবারের নির্বাচনে ১২টি প্যানেল থাকলেও হাড্ডাহাড্ডি ভোটের লড়াই হবে মূলত ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের প্যানেলের মধ্যে। দুই পক্ষই জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। ছাত্রদলের নেতারা বলছেন, ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের প্রভাব চাকসু নির্বাচনে পড়বে না। এখানকার প্রেক্ষাপট আলাদা, চবি ক্যাম্পাসে ছাত্রদল পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করে আসছে। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি কিংবা সন্ত্রাসের কোনো অভিযোগ নেই। ছাত্রদলের প্যানেলে যারা প্রার্থী হয়েছেন তারা মেধাবী এবং গ্রহণযোগ্য। তাদের প্রত্যাশা শিক্ষার্থীরা ছাত্রদলের প্যানেলকেই বেছে নেবেন। অন্যদিকে শিবির নেতারা বলছেন, ডাকসু আর জাকসুর পর চাকসুতেও তারা বড় ধরনের বিজয় অর্জন করতে যাচ্ছেন। এ ক্যাম্পাস ছাত্রশিবিরের ঘাঁটি। এখানে শিবিরের অনেক নেতা কর্মী জীবন দিয়েছেন। ৫ আগস্টের পর শিবির শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচি নিয়ে ক্যাম্পাসে ছিল। শিক্ষার্থীরা ব্যালটের মাধ্যমে এর প্রতিদান দেবেন। অন্য প্যানেলের প্রার্থীরাও বিজয় ছিনিয়ে আনতে শেষ মুহূর্তে নানা প্রচার চালিয়েছেন।

সর্বশেষ চাকসু নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। তখন ছাত্রশিবিরকে মোকাবেলায় ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, জাতীয় ছাত্র সমাজসহ দেশের ১২টি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠিত হয়। তারা ঐক্যবদ্ধ প্যানেল দিয়ে শিবিরের প্যানেলকে সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে। তবে এবার ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে কোনো জোট হয়নি। ছাত্রদল স্বতন্ত্র প্যানেলে নির্বাচন করছে। এর পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলনের ছাত্র সংগঠন, বাম সংগঠনসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন পৃথক প্যানেলে নির্বাচন করছে। কয়েকটি স্বতন্ত্র প্যানেলও ভোটের লড়াইয়ে সামিল হয়েছে। স্বতন্ত প্রার্থীদের কয়েকজন সমর্থন দেয়ায় বিশ^বিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ মামুন উর রশিদ মামুনকে আজীবনের জন্য ছাত্রদল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, জুলাই আন্দোলনে জীবন বাজি রেখে ভূমিকা রাখার পরও তাকে প্রার্থী করা হয়নি। আর এ কারণে তিনি ছাত্রদল প্যানেলের বদলে স্বতন্ত্রদের পক্ষে কাজ করছিলেন।

এবারের নির্বাচনে ভোটার ২৭ হাজার ৬৩৪ জন। চাকসু ও হল সংসদে মোট প্রার্থী হয়েছেন ৯০৮ জন। ভোটারদের বিরাট একটি অংশ ক্যাম্পাস থেকে ২০ কিলোমিটার দূরবর্তী চট্টগ্রাম মহানগরীতে বসবাস করেন। আর এজন্যই শিক্ষার্থীদের ভোট দেওয়ার সুবিধার্থে নির্বাচনের দিন শাটল ট্রেনের সূচি বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ ট্রেনও চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এসব বাস বিশ^বিদ্যালয়ে যাতায়াত করবে।

নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে নির্বাচনকে স্বচ্ছ করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। চাকসু নির্বাচনে ভোট হবে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে। ভোট দেয়ার গোপন কক্ষও সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় থাকবে। ভোট গণনার সময় গণনাকেন্দ্রে কী হচ্ছে তা লাইভে দেখা যাবে। বিদ্যুৎ চলে গেলেও সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষিত থাকবে। প্রতি কেন্দ্রে দুটি করে মেডিকেল টিম থাকবে। ভোটের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪টি প্রবেশপথের মধ্যে ৭টি বন্ধ থাকবে। শিক্ষার্থীরা পরিচয়পত্র দেখিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন। বহিরাগতদের প্রবেশ ঠেকাতে ২৪টি পয়েন্টে নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রিসাইডিং কর্মকর্তার অনুরোধ ছাড়া যে ভবনে ভোট হবে, সেখানে কেউ প্রবেশ করবে না। ভোটগ্রহণ শেষে দ্রুত ফলাফল ঘোষণা করতে নির্বাচনের ব্যালট পেপার ওএমআর পদ্ধতিতে করা হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য এ কে এম আরিফুল হক সিদ্দিকী জানান, নির্বাচনে ব্যালট ওএমআর পদ্ধতিতে করা হয়েছে। ভোটারেরা ব্যালটে বৃত্ত ভরাট করে নিজেদের ভোট প্রদান করবেন। এতে কম সময়ে ভোটের ফলাফল প্রকাশ করা যাবে।

এবার একজন ভোটার ৪০টি পদে ভোট দেবেন। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ২৬টি ও হল সংসদের ১৪টি পদে ভোট দিতে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট। ফলে একজন শিক্ষার্থীকে গড়ে প্রতি ২০ সেকেন্ডে একটি করে ভোট দিতে হবে। ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে ১৫ অক্টোবর সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। পাঁচটি অনুষদ ভবনে ভোটকেন্দ্র থাকবে ১৫টি ও বুথ থাকবে ৭০০টি। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের জন্য আলাদা বুথ থাকবে। তবে পদ বেশি হওয়ায় ভোট দিতে সময় লাগতে পারে। নির্বাচন পরিচালনা কমিটি বলছে, সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ভোটকেন্দ্রের ভিড় ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে। একজন শিক্ষার্থীকে পাঁচটি ব্যালট পেপার দেয়া হবে। এর মধ্যে চারটিতে থাকবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের প্রার্থীদের নাম ও ব্যালট নম্বর। অন্য একটিতে থাকবে হল সংসদের প্রার্থীদের নাম ও ব্যালট নম্বর। এতে ভোটাররা দ্রুত বুঝতে পারবেন কোন ব্যালটে কোন পদ রয়েছে। ভোট গণনা হবে অপটিক্যাল মার্ক রিডার বা ওএমআর পদ্ধতিতে।

এদিকে গতকাল প্রচারণার শেষ দিনে ব্যস্ত সময় পার করেছেন প্রার্থীরা। রেল স্টেশন, ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার চত্বর, বুদ্ধিজীবী চত্বর, লেডিস ঝুপড়ি, কলা ঝুপড়ি, সমাজবিজ্ঞান ঝুপড়ি, প্রতিটি অনুষদ প্রাঙ্গণ, আবাসিক হল প্রাঙ্গণ, জিরো পয়েন্টসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ছিল প্রার্থীদের প্রচারণার ভীড়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী চত্বরে দেখা যায়, প্রার্থীরা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন। নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন ভোটারদের। ভোটাররাও প্রার্থীদের নানা ধরণের প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর দ্বারে দ্বারে গিয়ে আলোচনায় রয়েছেন শাফায়েত হোসেন। তিনি ছাত্রদল মনোনীত প্যানেল থেকে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা খুব কৌতুহল নিয়ে শাফায়েতকে প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। এদিকে একই প্যানেলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) প্রার্থী আইয়ুবুর রহমান তৌফিকও শিক্ষার্থীদের আগ্রহে রয়েছেন। আকর্ষণীয় প্রচারণাপত্র দিয়ে চালাচ্ছেন নির্বাচনী প্রচারণা।

একই সময় ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের সহ-সভাপতি (ভিপি) প্রার্থী ইবরাহীম হোসেন রনিকে প্রচারণাপত্র বিতরণ করতে দেখা যায়। এসময় তিনি শিক্ষার্থীদের নির্বাচনী ইশতেহারগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। নির্বাচনের দিন ভোট দিতে আসার জন্য তিনি অনুরোধ করেন। একই সময় বুদ্ধিজীবী চত্বরে প্রচারণা চালায় বৈচিত্র্যের ঐক্য প্যানেলের প্রার্থীরা। প্রচারণায় শেষ দিন হওয়ায় ভোটাররাও খুব আগ্রহ দেখান প্রার্থীদের। প্রার্থীদের সবচেয়ে বেশি আনাগোনা দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের লেডিস ঝুপড়িতে। যেখানে প্রায় প্রত্যেক প্যানেলের প্রার্থীরা প্রচারণা চালিয়েছেন। প্রচারণার মধ্যেই অনলাইনে মিথ্যা তথ্য, বিভ্রান্তি ও বুলিং মোকাবেলায় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাসহ নানা অভিযোগ ও দাবি নিয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে শিবির সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী চত্বরে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়। শিবির সমর্থিত প্যানেলের এজিএস পদপ্রার্থী সাজ্জাত হোছন মুন্নার সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী সাঈদ বিন হাবিব।

লিখিত বক্তব্য সাঈদ বিন হাবিব ৪টি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেন। বিষয়গুলো হলো- অনলাইনে মিথ্যা তথ্য, বিভ্রান্তি ও বুলিং মোকাবেলায় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা; আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং এ বিষয়ে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা। নির্বাচনের দিন অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য জরুরি রেসপন্স টিম গঠন করা এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ ও নিখুঁত ভোট ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

এ প্যানেলের সহ-সভাপতি (ভিপি) প্রার্থী ইবরাহীম হোসেন রনি বলেন, চাকসু নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশন এখনো অনেক বিষয় স্পষ্ট করেনি। এছাড়া প্রতিনিয়ত প্রার্থীরা আচরণবিধি লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন। কিন্তু চাকসু নির্বাচন কমিশন এবিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।

নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মনির উদ্দিন বলেন, আমরা নির্বাচনের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করেছি। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর চাকসু নির্বাচন করতে পেরে আমরা খুবই উচ্ছ্বসিত। শিক্ষার্থীরাও এই নির্বাচন নিয়ে খুবই কৌতুহলী। আমরা আগামী ১৫ তারিখ একটি স্বচ্ছ নির্বাচন উপহার দিব ইনশাআল্লাহ।