Image description

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গুটিকয় কর্মকর্তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদায়ন। সিপাহি থেকে শুরু করে কমিশনার-অতিরিক্ত কমিশনার ও উপকমিশনার এমনকি সহকারী কমিশনারকে কোন ডিভিশনে বা কাস্টম হাউসের কোন গ্রুপে পোস্টিং করা হবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। যদিও অভ্যন্তরীণ অর্ডার করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কমিশনারের। এ ছাড়া বলয়ের কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের পদায়ন করতে মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়। আর অপছন্দের কর্মকর্তাদের নানা অজুহাতে নন-ফাংশনাল দপ্তরে পদায়ন করা হয়। এমনকি কর্মকর্তারা বন্ধের সময়ও যাতে ঢাকায় না আসতে পারেন—এমন নির্দেশনাও দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সংস্থাটির শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের কর্তাদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া এনবিআরের আন্দোলনকে পুঁজি করে অপছন্দের কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত থেকে শুরু করে শাস্তিমূলক বদলিরও অভিযোগ রয়েছে। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নতুন প্রশাসনে সদস্য হিসেবে পদোন্নতি পান ১৫ ব্যাচের কর্মকর্তা মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। সদ্য ওএসডি হওয়া মোহাম্মদ বেলাল হোসেন চৌধুরীর বন্ধু হিসেবে এনবিআরের প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। আর সদস্য হয়েই রপ্তানি ও বন্ডের দায়িত্ব পান। তবে এনবিআর পৃথকীকরণ আন্দোলনের প্রথম দিকে যোগ দিলেও হাওয়া বদলাতে তিনি সটকে পড়েন। আর আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে পুরস্কার হিসেবে তাকে এনবিআরের শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব পেয়েই মনোযোগ দেন তার বন্ধু এবং তার নিজস্ব বলয় তৈরিতে। আন্দোলনকে পুঁজি করে প্রথমেই এনবিআরের শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের প্রথম সচিব আমীমুল ইহসানকে সরিয়ে নিজের লোক হিসেবে নিয়ে আসেন ২৮ ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আরিফুল ইসলামকে। ঢাকা কাস্টম হাউসে তার কর্মকাণ্ডের জন্য তিন মাসের মাথায় স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। বলয় তৈরি করতে প্রশাসনের প্রথম সচিব হিসেবে এনবিআরে নিয়ে আসা হয়। কারণ, রাজস্ব কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কমিশনার পর্যন্ত পদায়নের দায়িত্ব এই প্রশাসনের হাতে। পরের ধাপে শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের দ্বিতীয় সচিব থেকে শুরু করে কম্পিউটার অপারেটর সবাইকে বদলি করেন। আর ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের প্রভাবে আন্দোলনে যুক্ত থাকা কর্মকর্তাদের গণবদলি শুরু করেন। তবে নিজের বলয়ের কর্মকর্তাদের আন্দোলনে যুক্ত থাকার পরও ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে পদায়ন করেন। এনবিআর থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে চলে এই প্র্যাকটিস। তার উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মোয়াজ্জেম হোসেন ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার থাকাকালীন নিজের বলয়ের ২৯ ব্যাচের যুগ্ম কমিশনার মারুফুর রহমানকে নতুন প্রসাশনে আসার পর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে পদায়ন করেন। এই যুগ্ম কমিশনারের কর্মকাণ্ডে নানা বিতর্ক তৈরি হলে তিনি তাকে কাস্টম হাউসের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্বে রাখতে কলকাঠি নাড়েন। শুধু এখানেই শেষ নয়, এনবিআরের আন্দোলনে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস শাটডাউন করার কারণে কমিশনারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অথচ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে মারুফ পান আরও গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর। যদিও চাপের মুখে গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে বদলি করা হয়েছে।

পদায়নের বিষয়ে বক্তব্য দিতে রাজি না হলেও দ্বিতীয় সচিবকে বদলি করার বিষয়ে এনবিআরের শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন কালবেলাকে বলেন, সিক্রেসি না মানায় এনবিআরের শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের দ্বিতীয় সচিবকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু যুগ্ম কমিশনার আরিফুল ইসলাম বা মোহাম্মদ মারুফুর রহমান নন, কাস্টম-ভ্যাট এমনকি সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলে নিজ বলয়ের কর্মকর্তাদের যুক্ত করেছেন। তার জ্বলন্ত উদাহরণ শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে মারুফুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ৪০ ব্যাচের কর্মকর্তা রেজওয়ান আলমগীরকে শুল্ক গোয়েন্দায় পদায়ন করে ঢাকা কাস্টম হাউসের এয়ারফ্রেইটের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মোয়াজ্জেম হোসেনের কাছের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদের চাচাতো ভাইকে শুল্ক গোয়েন্দার গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ বলয়ের বাইরে এক অতিরিক্ত কমিশনারকে পদায়ন করার দুদিন পরই আবার এনবিআরে সংযুক্ত করা হয়। শুধু শুল্ক গোয়েন্দা বা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসই নয়, বন্ড কমিশনারেটেও এমন বলয় তৈরি করা হয়েছে। আর বলয়ের বাইরে কিংবা এই সিন্ডিকেটের রোষানলে পড়ে আন্দোলন না করেও সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন অনেক কর্মকর্তা।

এনবিআরের বদলি পদায়ন ইস্যুতে ক্যাডার-নন ক্যাডার অর্ধশতাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে কালবেলা। তাদের অভিযোগ, মোয়াজ্জেম-বেলাল বলয়ের কর্মকর্তা হলেই সবকিছু মাফ। না হলে ভালো কাজ করে এমনকি আন্দোলনে সম্পৃক্ত না থেকেও সাময়িক বরখাস্ত এবং শাস্তিমূলক বদলির শিকার হতে হচ্ছে। এ ছাড়া এনবিআর থেকে শাস্তিমূলক বদলি হওয়া কর্মকর্তাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের বদলি নিয়ে ঘটেছে আরও তুঘলকি কাণ্ড। এনবিআরের বদলির একটি নীতিমালা বিদ্যমান রয়েছে। এই নীতিমালায় বদলির ক্ষেত্রে ক, খ, গ, ঘ নামে চারটি ক্যাটাগরি করা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ক ক্যাটাগরিতে রয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট ট্রেনিং একাডেমি, কাস্টম মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেট, কাস্টম রেয়াত ও প্রত্যর্পণ অধিদপ্তর ও কাস্টম রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিশনারেট। আর পদায়নের ‘খ’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্ট সেল, কাস্টম হাউস, ঢাকা, চট্টগ্রাম, আইসিডি, কাস্টম বন্ড কমিশনারেট উত্তর/দক্ষিণ, কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট পূর্ব ও উত্তর। এ ছাড়া ‘গ’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে ভ্যাট কমিশনারেট দক্ষিণ/পশ্চিম ও চট্টগ্রাম ভ্যাট, চট্টগ্রাম বন্ড, কাস্টম হাউস বেনাপোল/মোংলা/পানগাঁও, কাস্টম গোয়েন্দা ও নিরীক্ষা গোয়েন্দা ভ্যাট। সর্বশেষ ‘ঘ’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ), ভ্যাট কমিশনারেট, কুমিল্লা, সিলেট, রংপুর, রাজশাহী, যশোর ও খুলনা। আর পদায়নের ক্ষেত্রে ‘ক’ থেকে ‘খ’ ক্যাটাগরিতে যাবে, কিন্তু ‘খ’ থেকে ‘গ’ ক্যাটাগরিতে দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া ‘খ’ থেকে ‘খ’ এবং ‘গ’ থেকে ‘গ’ ক্যাটাগরিতে রাখার নিয়ম সাধারণত নেই। এ ছাড়া ‘ক’ থেকে ‘ঘ’ ক্যাটাগরিতে সাধারণত শাস্তিমূলক পদায়ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মূলত এনবিআরের কাস্টম-ভ্যাটের কর্মকর্তাদের কাজের আগ্রহ বাড়ানো এবং রাজস্ব আহরণ বাড়াতে এই ধরনের নীতিমালা করা হয়েছিল বলেও নিশ্চিত করেছেন এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা। কিন্তু বর্তমান প্রশাসন এসব নীতিমালার ধার ধারে না।