Image description

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা তিন মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর যে ১৫ কর্মকর্তাকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে, তাঁদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনী নিজেদের হেফাজতে রাখতে চায় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে।

এই বিষয়ে সেনা কর্তৃপক্ষের একটা ভাবনা হচ্ছে, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসামি হওয়া এসব কর্মকর্তা সেনা হেফাজতে থাকবে। মামলার নির্দিষ্ট তারিখে সেনাবাহিনী এঁদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করবে, আদালতের কার্যক্রম শেষে আবার হেফাজতে নিয়ে যাবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়েছেন। আইন অনুযায়ী কোনো আসামিকে গ্রেপ্তারের পর অনতিবিলম্বে আদালতে হাজির করতে হবে। এরপর আদালত সিদ্ধান্ত দেবেন, তাঁদের কারাগারে পাঠাবেন নাকি জামিন দেবেন। তবে সরকার চাইলে কোনো স্থাপনাকে কারাগার ঘোষণা করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আসামিরা কোথায় থাকবেন, সেটা আদালত নির্ধারণ করবেন।

আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকার যদি কোনো বাড়িকে সাবজেল বা উপকারাগার ঘোষণা করে, সেখানে মামলার আসামি রাখতে পারেন। এমন নজির এর আগেও রয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে এক-এগারোর সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারের পর সংসদ ভবন এলাকায় দুটি বাড়িকে সাবজেল ঘোষণা করে সেখানে তাঁদের রাখা হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তিন মামলায় গত বুধবার সেনাবাহিনীর ২৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। একসঙ্গে এতসংখ্যক সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি দেশে এর আগে ঘটেনি।

তাঁদের মধ্যে ১৫ জন এখনো চাকরিতে আছেন। একজন এলপিআরে (অবসরোত্তর ছুটিতে) আছেন। তাঁদের আদালতে হাজির করার বিষয়ে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব আছে। সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে ১৫ জনকে হেফাজতে নিয়ে গেছে। একজন আত্মগোপনে চলে গেছেন। তিনি হলেন মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ। ডিজিএফআইয়ে সাবেক এই পরিচালক সর্বশেষ সিলেটে সেনাবাহিনীর স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকসে (এসআইঅ্যান্ডটি) কমান্ড্যান্ট পদে ছিলেন। এর আগে তিনি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক সচিব ছিলেন।

এর বাইরে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত ৯ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। সেনা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, অবসরপ্রাপ্তদের বিষয়ে পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। ওই কর্মকর্তারা নিজেরাও চাইলে আত্মসমর্পণ করতে পারেন।

অনেকেই দেশে নেই

তবে অবসরপ্রাপ্ত এসব কর্মকর্তার প্রায় সবাই ইতিমধ্যে দেশ ছেড়েছেন বলে সেনাবাহিনী–সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে। এই নয়জনের মধ্যে পাঁচজন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি)। তাঁরা হলেন লে. জেনারেল (অব.) মো. আকবর হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আবেদিন, লে. জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আলম, লে. জেনারেল (অব.) আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী ও মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক। তাঁদের কেউ দেশে নেই বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে।

বাকিদের মধ্যে মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান বলে জানা গেছে। তারিক সিদ্দিক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন।

অবসরপ্রাপ্ত অপর কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ (অব.) তৌহিদুল ইসলাম, লে. কর্নেল (অব.) মখছুরুল হক ও লে. কর্নেল (অব.) খায়রুল ইসলাম। তাঁরা ডিজিএফআই ও র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত ছিলেন।

গত বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনটি মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি মামলা হচ্ছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুম-নির্যাতনের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়। এতে শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

অপর মামলাটি হচ্ছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা ও বনশ্রী এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়। এতে চারজনকে আসামি করা হয়। তাঁরা হলেন বিজিবির সাবেক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ রেদোয়ানুল ইসলাম ও মেজর মো. রাফাত-বিন-আলম মুন এবং পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. রাশেদুল ইসলাম ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মশিউর রহমান।

তিন মামলায় মোট ৩২ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে র‍্যাবের সাবেক তিন মহাপরিচালক (ডিজি) রয়েছেন। তাঁরা হলেন বেনজীর আহমেদ, এম খুরশিদ হোসেন ও হারুন অর রশিদ। বেনজীর পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হয়েছিলেন। বাকি দুজন অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে অবসরে গেছেন। তাঁরা সবাই আত্মগোপনে রয়েছেন। এর মধ্যে বেনজীর দেশের বাইরে বলে জানা গেছে।

কর্মরত যারা হেফাজতে

বর্তমান সেনা হেফাজতে থাকা ১৫ জনের মধ্যে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন এলপিআরে আছেন। বাকিরা কর্মরত কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন— মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কে এম আজাদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুব আলম, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম, লে. কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল, লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভীর মাজহার সিদ্দিকী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ রেদোয়ানুল ইসলাম ও মেজর মো. রাফাত-বিন-আলম মুন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সব আসামিকে গ্রেপ্তার করে ২২ অক্টোবরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার জন্য আদেশ দিয়েছেন।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে পাঠানো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাস্তবায়ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে পাঠানো হয়েছে।

চাকরি থাকা না থাকা নিয়ে প্রশ্ন

চলতি বছরের ৬ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনের যে সংশোধনী আনা হয় তাতে বলা হয়, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হলে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য হবেন। কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সদস্য, কমিশনার, চেয়ারম্যান, মেয়র বা প্রশাসক হিসেবে নির্বাচিত হতে পারবেন না বা এসব পদে নিয়োগ পাবেন না। এমনকি প্রজাতন্ত্রের (সরকারের) কোনো সেবায় নিয়োগ পাওয়ারও অযোগ্য হবেন। সরকারের কোনো অফিসে (পাবলিক অফিস) থাকতে পারবেন না। তবে ট্রাইব্যুনাল কাউকে অব্যাহতি বা খালাস দিলে তাঁর ক্ষেত্রে এসব বিষয় প্রযোজ্য হবে না বলেও আইনটির সংশোধনীতে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রসিকিউশনের বক্তব্য অনুযায়ী, কারও বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হলে তখন থেকেই তাঁর আর চাকরিতে থাকার সুযোগ নেই। তাহলে হেফাজতে থাকা ১৫ সেনা কর্মকর্তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী হবে? এ বিষয়ে গতকাল বিকেলে ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়েছিল। জবাবে সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনীতে যে ‘ডিসকোয়ালিফিকেশনের’ কথা বলা হয়েছে, এর সঠিক প্রয়োগবিধি বা ব্যাখ্যা এখনো প্রকাশিত হয়নি। যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। এই বিধান সশস্ত্র বাহিনীতে, বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে কীভাবে কার্যকর হবে, সেটা জানতে হবে।