
প্রশিক্ষণের নামে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের নেশা যেন ছাড়ছেই না। অর্থনৈতিক মন্দায় গত কয়েক বছর সরকারি অর্থে বিদেশে প্রশিক্ষণ বা ভ্রমন বন্ধ থাকলেও মন্ত্রণালয়গুলো প্রস্তাব দেওয়া বাদ রাখেনি। সম্প্রতি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাজে গতি সঞ্চারের নামে প্রায় ৩০৩ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। সেখানে ৩০০ কর্মকর্তার বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
সংকটের এই সময় সরকারের টাকায় বিদেশ প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারাই। তাঁরা বলছেন, এ হচ্ছে প্রশিক্ষণের নামে জনগণের টাকায় বিদেশ ভ্রমণ বিলাসের ধান্দা।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রস্তাবিত যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পে বলা হচ্ছে, এই প্রকল্পে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, মনিটরিং জোরদার এবং অফিসের আধুনিকীকরণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে প্রকল্পের একটি বড় অংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও ভ্রমণে।
তার মধ্যে ৩০০ কর্মকর্তা বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে যাবেন, আর মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম মনিটরিংয়ের নামে ভাড়ায় নেওয়া হবে ১২৯টি গাড়ি। কর্মকর্তাদের দেওয়া হবে ৭৮৫টি মোটরসাইকেল।
প্রস্তাব করা হয়েছে, প্রকল্পটি ২০২৫ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০২৮ সালের জুনে শেষ হবে। পুরো ৩০৩ কোটি টাকা ব্যয় আনা হবে সরকারি কোষাগার থেকে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগ প্রকল্পটি যাচাই করছে।
এই অপ্রয়োজনীয় বিদেশ প্রশিক্ষণ ও বিলাসী গাড়ি ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গাজী সাইফুজ্জামান কথা বলতে রাজি হননি। তিনি জানিয়েছেন যা বলার তা পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভাতেই বলবেন। তবে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) আব্দুর রউফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এই প্রকল্প প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে দেখব।
তাতে কোনটি প্রয়োজন আর কোনটি প্রয়োজন না, তা দেখব। আর কেন প্রস্তাব দিয়েছে সেটাও পিইসি সভায় জানতে চাওয়া হবে।’
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ওই প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আধুনিক প্রশাসনিক জ্ঞান, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা ও মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম তদারকির সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্প চলাকালীন তিন হাজারজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, যার মধ্যে দেশীয় ও বিদেশি প্রশিক্ষণ দুটিই থাকবে। বিদেশে প্রশিক্ষণ অংশটি নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে।
যুব উন্নয়নের কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিকমানের প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা দেশের যুব কার্যক্রমকে আধুনিকায়নে সহায়তা করবে। তবে পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, আগের অনুরূপ প্রকল্পগুলোতেও বিদেশ প্রশিক্ষণের সুফল তেমন দেখা যায়নি, বরং প্রকৃত কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির বদলে প্রশাসনিক ব্যয়ই বেড়েছে।
প্রস্তাব অনুযায়ী, মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম তদারকি জোরদার করার জন্য ১২৯টি গাড়ি ভাড়ায় নেওয়া হবে। বর্তমানে অধিকাংশ জেলা কার্যালয়ে নিজস্ব যানবাহন না থাকায় কর্মকর্তাদের উপজেলা পর্যায়ে যাতায়াতে ভোগান্তি হয়। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষকদের চলাচলের সুবিধার্থে ৭৮৫টি মোটরসাইকেল ক্রয় করার পরিকল্পনাও রয়েছে। অধিদপ্তরের দাবি, গাড়ি ও মোটরসাইকেল না থাকায় প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে, ফলে ‘যুব উন্নয়নের গতি থমকে যাচ্ছে।’
প্রকল্প প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর দক্ষতা উন্নয়ন, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও যুব ঋণ প্রদানের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসে কাজ করছে। প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ যুবক-যুবতীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মকর্মসংস্থানে যুক্ত করা হয়। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রমে মনিটরিং দুর্বল হওয়া, আধুনিক সরঞ্জাম ও যানবাহনের অভাবে অনেক সময় কার্যক্রমের গতি কমে যায়। সেই সীমাবদ্ধতা কাটাতে এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
তবে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পে মূলত প্রশাসনিক ব্যয়ের অনুপাত অস্বাভাবিকভাবে বেশি। মাঠ পর্যায়ে যুবদের সরাসরি সুবিধা প্রদানের পরিবর্তে প্রকল্পের বড় অংশ ব্যয় হবে কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ, বিদেশ সফর, গাড়িভাড়া এবং সরঞ্জাম ক্রয়ে। পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ ধরনের ‘ক্ষমতা বৃদ্ধি’ প্রকল্পের অনেক উদাহরণ আছে, কিন্তু এগুলোর প্রকৃত ফলাফল প্রায়ই সীমিত থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রকল্প শেষে কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন দেখা যায় না।