
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে অন্য সমমনা দলগুলোকে নিয়ে চলছে আলাদা আলাদা জোট গঠনের প্রক্রিয়া। এমন প্রেক্ষাপটে সম্ভাব্য এই দুই জোটের বাইরে স্বতন্ত তৃতীয় আরেকটি বৃহত্তর কোনো ‘রাজনৈতিক সমঝোতা বা বোঝাপড়া’ অর্থাৎ নির্বাচনী জোট গড়ে তোলা যায় কি না, তা নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) ও গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চের। যদিও এই আলোচনায় আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি কিংবা চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর উত্তরায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আব্দুর রবের বাসায় এই বৈঠক হয়। তবে নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসায় নতুন এই জোটের উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রস্তুতির সময়টা একেবারেই অপ্রতুল বলে মনে করছে দলগুলো। তারপরও একটি ‘বৃহত্তর’ রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে দলগুলো শিগগির আবারও আলোচনায় বসবে।
জানা গেছে, জেএসডির সহসভাপতি তানিয়া রবের সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার রাতের বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, মঞ্চের সমন্বয়ক ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ূম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র বাম ও প্রগতিশীল ঘরানার ছয়টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জোট ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ এরই মধ্যে একসঙ্গে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই জোট তিনশ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে প্রথম দফায় ১৪২ আসনে প্রার্থীর নামও প্রকাশ করেছে। ওই সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে বিএনপিসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী জোট তথা রাজনৈতিক সমঝোতা গড়ে উঠতে পারে। এমনকি সেই জোটের বাইরে আরও বৃহত্তর জোটের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপিত হতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটের মধ্যে এনসিপি, এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের বৈঠক হলো, যেখানে ‘রাজনৈতিক সমঝোতার’ সম্ভাবনা নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে বলে বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক নেতা কালবেলাকে নিশ্চিত করেছেন।
আলোচনায় অংশ নেওয়া একাধিক নেতা বলেন, বৈঠকটি ছিল মূলত পারস্পরিক বোঝাপড়ার; জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি এবং আগামী নির্বাচন সামনে রেখে কে কী ভাবছেন, সেটা নিয়ে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হওয়া অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধভাবে পথ চলা যায় কি না, নিজেরা জোটবদ্ধ হয়ে অন্য বৃহৎ জোটের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায় কি না, বা যারা জোট করতে আগ্রহী তাদের সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা এগিয়ে নেওয়া—আলোচনাটা মোটামুটি এর ভেতরই সীমাবদ্ধ ছিল।
বৈঠকে অংশ নেওয়া কয়েকজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়াকে সবাই যৌক্তিক মনে করছেন। এমন অবস্থায় দলগুলোর নেতাদের অভিমত, নির্বাচন সন্নিকটে; ফলে বিএনপি-জামায়াতের বাইরে আলাদা ‘নির্বাচনী জোট’ গঠনের জন্য সময়টাও খুবই কম। এই উদ্যোগটা যদি আরও ছয় মাস আগে থেকে নেওয়া যেত, তাহলে রাজনীতিতে একটা ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ অবস্থা তৈরি হতো। তারপরও নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশে সংসদ ও সম্ভাবনাকে সামনে রেখে তারা (এই দলগুলো) যদি একটা জায়গায় পৌঁছাতে পারেন, তাহলে সেটাও রাজনীতি ও দেশের জন্য সহায়ক হবে।
জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক গতকাল শুক্রবার কালবেলাকে বলেন, ‘বৈঠকটি ছিল সম্প্রীতির বৈঠক। দেখা-সাক্ষাৎ, আলোচনা; তার সঙ্গে আগামী জাতীয় নির্বাচন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতিসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা কথাবার্তা হয়েছে। মাঝেমধ্যে আমাদের এমন দেখা-সাক্ষাৎ হবে, আমরা এটা কন্টিনিউ করব। সার্বিক পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা, ডেভেলপমেন্টগুলো দেখা ইত্যাদি।’
এ প্রসঙ্গে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু গতকাল রাতে কালবেলাকে বলেন, ‘গণতন্ত্র মঞ্চভুক্ত ৬টি দল এবং এনসিপি, এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদ—এই নয়টি দলের মধ্যে এর আগে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে একটি বৈঠক হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার আ স ম আবদুর রবের উত্তরার বাসায় একটি সম্প্রীতি বৈঠক হয়েছে। এতে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ এবং আগামী নির্বাচন নিয়ে আমাদের কোন দলের কী ভাবনা, সেটা নিয়ে কিছু খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। এখানে জোট গঠন নিয়ে বলার মতো সিদ্ধান্তকারী কিছু হয়নি। তবে আমরা সহসাই আবারও বসব।’
এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর এনসিপি, এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করে গণতন্ত্র মঞ্চ। অবশ্য সেখানে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুতে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব কমানোর উপায় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। এ ছাড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে বড় দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার পথ খোঁজার উদ্যোগের অংশ হিসেবে গত ৭ অক্টোবর ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছিল গণতন্ত্র মঞ্চ।