Image description

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নারী নেত্রীদের কপাল খুলবে এবার। দলটির এবার ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫টির বেশি আসনে নারীদের সরাসরি মনোনয়ন দেবে। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে তরুণ নারী নেত্রীরা।

বিএনপি দলীয় সূত্রে জানা যায়, দেশের নারীসমাজ এখনো পিছিয়ে আছে। তাদের সমাজে আরো বেশি প্রতিষ্ঠিত করতে হলে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো প্রয়োজন। তার ধারাবাহিকতায় এবারের নির্বাচনে দলটির পক্ষ থেকে সরাসরি ৫ শতাংশ বা ১৫-এর অধিক নারীকে মনোনয়ন দেবে। ইতোমধ্যে সংস্কার কমিশনেও সরাসরি নারীদের ৫ শতাংশ মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে নিজেদের প্রস্তাব দিয়েছে। সেই হিসেবে এবারের নির্বাচনে বিএনপির নারী নেত্রীদের নির্বাচনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এর মধ্যে শতাধিক নারী নেত্রী মনোনয়ন চেয়ে দেশের বিভিন্ন সংসদীয় আসনে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।

এদিকে নারীর ক্ষমতায়নে জাতীয় সংসদে ৫০টি আসন সংরক্ষিত রয়েছে। তবে ঐকমত্য কমিশনে প্রস্তাব ছিল নারীদের জন্য ১০০ আসন করার। রাজনৈতিক দলগুলো সেই প্রস্তাবে রাজি হলেও বিএনপির প্রস্তাব ছিল- এবারের সংসদ নির্বাচন বিদ্যমান ব্যবস্থায় হবে আর পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে ১০০ আসন বৃদ্ধি করা হবে। তবে দলটি আসন্ন নির্বাচনে মোট প্রার্থীর ৫ শতাংশ নারী প্রার্থী দেবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য হয়ে গেলে নারীদের জন্য ১০০ আসন থাকবে।

নির্বাচন কমিশনের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলগুলোর সব কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জন করার কথা ছিল ২০২০ সালের মধ্যে। তবে তা না পারায় সময় ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে নির্বাচনে কত শতাংশ প্রার্থী থাকবে এ নিয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

বাংলাদেশের নির্বাচনি ফলাফল বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের হিসাব অনুযায়ী ৩৯ জন নারী প্রার্থীর মধ্যে ৫ জন, ১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচনে ৩৬ নারী প্রার্থীর মধ্যে ৮ জন, ২০০১ সালের নির্বাচনে ৩৮ জন নারী প্রার্থীর মধ্যে ৬ জন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৫৯ জন নারী প্রার্থীর মধ্যে ১৯ জন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে ২৯ জন নারী প্রার্থীর মধ্যে ১৮ জন নারী সরাসরি নির্বাচিত হয়েছিলেন সংসদ সদস্য হিসেবে। ২০১৮ সালের অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে ৬৯ জন নারী প্রার্থীর মধ্যে ২২ জন সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ১৯ জন নারী সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে বৈধতা নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন ছিল।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনো আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ বৈষম্য রয়ে গেছে। পুরুষ নেতারা নারীদের এগিয়ে যেতে দিতে চায় না, তারা মনে করে নারী নেতৃত্ব দিতে পারবে না। নেতৃত্বের কাজ পুরুষরা করবে। আবার নারীদের পরিবার-সংসারে সময় দিতে হয়। এছাড়া সমাজও নারীরা বেশি এগিয়ে গেলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। সুযোগ পেলে নারীরা যে রাজনীতিতে এগিয়ে যেতে পারে তার উজ্জ্বল উদাহরণ হলো আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেছেন নারী। তারপরও আমাদের সমাজে, রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএনপির একক প্রার্থী চূড়ান্তের কাজ চলমান রয়েছে। খুব শিগগিরই তাদের সবুজ সংকেত দেওয়া হবে। বিএনপির ১৫০ থেকে ২০০ আসন রয়েছে যেখানে যে কোনো সময় নির্বাচন দিলে প্রার্থীরা জিতে আসতে পারবেন। নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে আমরা দলীয়ভাবে সরাসরি ৫ শতাংশ সরাসরি মনোনয়ন দেবে।

এমন বাস্তবতায় বিএনপি এবারের নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য সরাসরি ৫ শতাংশ নারীকে মনোনয়ন দেবে। দলটির মতে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের ফলে অভিজ্ঞতা অর্জন ও তৃণমূল পর্যায় থেকে নারীর মতপ্রকাশের সুযোগ পাবে। বাঙালি পরিবারগুলো, বাঙালি সমাজ নারীর ঘরের বাইরে যাওয়া দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে; কিন্তু রাজপথে নারী কোনো দলের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছে, রাজনীতি করছে- এমন নারীকে সাদরে বরণ করা হয় না। এ ভাবনার এখন বদল ঘটবে।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। স্বামীর পরিচয়সূত্রে রাজনীতিতে এলেও তিনি জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকাকালে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে তিনি রাজনীতির মাঠে এসেছেন। রাজপথে তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন দীর্ঘ ৯ বছর স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন করার মাধ্যমে। তিনি সক্রিয় কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপিকেও শক্তিশালী দলে পরিণত করেছেন। তিনি ছিলেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের আপসহীন নেত্রী। আসন্ন নির্বাচনেও তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলে একাধিক আসন থেকে নির্বাচন করবেন বলে জানা গেছে।

বিএনপি চেয়ারপারসন ও তিন বারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ছাড়াও এবারের নির্বাচনে শতাধিক নারী নেত্রী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য গণসংযোগ করছেন। তার মধ্যে রয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ সরাইল আসন থেকে নির্বাচন করতে চান দলটির সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। ফরিদপুর-২ আসনে বিএনপির মনোনয়ন চাইছেন বিএনপির সাবেক মহাসচিব এবং সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত কেএম ওবায়দুর রহমানের মেয়ে শামা ওবায়েদ।

মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে আছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আফরোজা খানম রিতা। তিনি মানিকগঞ্জ-৩ আসন থেকে নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। তার বাবা বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রী মরহুম হারুনুর রশিদ খান মুন্নু। ছিলেন দেশের সফল একজন শিল্পোদ্যোক্তা। দেশ-বিদেশে ছিলেন সমাদৃত। বাবার আসনটি পুনরুদ্ধারে রিতা ধানের শীষের কাণ্ডারী হবেন। দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মতে, আসনটি পুনরুদ্ধারে রিতার বিকল্প নেই। কারণ তিনি এখানে দলের নির্ভরযোগ্য এবং জনপ্রিয় প্রার্থী। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন তিনি। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের প্রায় ১৭ বছর শত ঝড়-ঝাপটা উপেক্ষা করে জেলা বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপস না করে দলীয় নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রেখেছেন আন্দোলন-সংগ্রামে। হামলা-মামলা, জেল-জুলুম ও নির্যাতিত নেতাকর্মীদের পাশে থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন। এখানে ধানের শীষের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছে তার ব্যক্তি জনপ্রিয়তা রয়েছে ব্যাপক। দলের প্রতি ত্যাগ ও জনপ্রিয়তার ধারেকাছেও নেই অন্য কেউ।

বিএনপির মানবাধিকারবিষয়ক সহ-সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সৈয়দা আশিফা আশরাফি পাপিয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ ও নাটোর-১ আসন থেকে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। যে কোনো একটি আসন থেকে নির্বাচন করতে চান। তিনি বলেন, ফ্যাসিস্ট আন্দোলনে আমার কী ভূমিকা ছিল সেটা দেশের মানুষ জানে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রতিটি আন্দোলনে জেল খেটেছি, কারাগারে গিয়েছি। রাজনীতির প্রতিটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি, এবারও মনোনয়ন পেয়ে আরেকটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হব। এবার হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর ও চুনারুঘাট) আসন থেকে শাম্মী আখতারের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।

এছাড়া জামালপুর-৪ আসন থেকে প্রার্থী হবেন বিএনপির সাবেক মহাসচিব ব্যারিস্টার আবদুস সালাম তালুকদারের মেয়ে সালিমা তালুকদার আরুনী। বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা সিলেট-২ থেকে নির্বাচন করতে চাচ্ছেন। এছাড়া প্রয়াত বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টুর স্ত্রী নাসিমা আক্তার কল্পনা মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি স্বামীর আসন ঢাকা থেকে ভোট করতে চান।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস তার স্ত্রী ও মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাসের জন্য মনোনয়ন চাইছেন ঢাকা-৯ আসন থেকে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান তার মেয়ে আমেরিকা প্রবাসী মাহরীন খানের জন্য নরসিংদীর একটি আসনে মনোনয়ন চাইছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) থেকে নির্বাচন করবেন, তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ কক্সবাজার-১ থেকে নির্বাচন করতে চান।