
বাংলাদেশের ধান গবেষণা ও কৃষি উৎপাদনের ইতিহাসে ব্রি ধান ২৮ ও ব্রি ধান ২৯ যুগান্তকারী দুটি নাম। ১৯৯৪ সালে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এই দুটি জাত অবমুক্ত করা হয়। একসময় সরকারের স্লোগানই ছিল ‘যদি আগাম ফলন চান, ব্রি ধান ২৮ লাগান; আর যদি অধিক ফলন চান, ব্রি ধান ২৯ লাগান’। কৃষক থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক পর্যন্ত সবাই এই জাত দুটিকে আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
প্রায় তিন দশক ধরে এই দুটি জাত ফলন, স্বাদ, দানার গুণগত মান, রোগ-বালাই সহনশীলতা—সব দিক দিয়েই এগুলো কৃষকদের কাছে ছিল প্রথম পছন্দ। দেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পেছনে এ দুটি জাতের অবদান অপরিসীম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখন এগুলোর দিন ফুরিয়ে আসছে।
কেন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে : গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা বলছেন, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন এগুলো উদ্ভাবিত হয়, তখন দেশে খাদ্যঘাটতি ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
ব্রি ধান ২৯-এর গড় ফলন হেক্টরপ্রতি প্রায় সাড়ে সাত টন, আর বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ১০ টন পর্যন্ত পাওয়া যেত। অন্যদিকে ব্রি ধান ২৮ ছিল আগাম চাষের জন্য উপযোগী এবং গড়ে ৫.৫ থেকে ছয় টন ফলন দিত। এই দুটি জাতের কারণে বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার ঘোষণা দেয়। বর্তমানে দেশের মোট ধান উৎপাদনের অর্ধেক আসে বোরো মৌসুম থেকে, একসময় এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই উৎপাদিত হতো এই দুই জাত থেকে।
শুরুতে ধান দুটি খুব ভালো ফলন দিলেও সম্প্রতি রোগ-বালাই, বিশেষ করে ছত্রাকজনিত ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, শুধু ব্রি ২৮ আবাদ করা অনেক জমিতে ধানের ৪০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত শীষ চিটায় পরিণত হয়। ফলে কৃষকরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ২০২৩ সালের বোরো মৌসুমে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়। আগাম ফসলের আশায় ব্রি ধান ২৮, ব্রি ধান ২৯ রোপণ করেছিলেন বহু কৃষক, কিন্তু ফলন আশানুরূপ হয়নি।
ফলে কৃষি বিভাগ সিদ্ধান্ত নেয় মাঠ থেকে এ দুটি জাত ধীরে ধীরে তুলে ফেলার।
আবাদ কমে আসার চিত্র : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, গত তিন বছরে এই জাত দুটির আবাদের জমি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। একসময় বোরো মৌসুমের মোট আবাদযোগ্য প্রায় ৫০ লাখ হেক্টরের মধ্যে ১৩ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে এই দুই জাতের ধানের চাষ হতো; বর্তমানে তা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
ব্রি ধান ২৮ জাতটি ২০২২-২৩ মৌসুমে আবাদ হয়েছিল পাঁচ লাখ ৭৬ হাজার ৪৭৬ হেক্টর জমিতে। পরের বছর তা নেমে আসে তিন লাখ ৮৮০ হেক্টরে। চলতি মৌসুমে আরো কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র দুই লাখ ১৯ হাজার ২৯৩ হেক্টরে। একইভাবে কমে এসেছে ব্রি ধান ২৯-এর চাষও। ২০২২-২৩ সালে সাত লাখ ৮৩ হাজার ১৯৬ হেক্টর জমিতে আবাদ হলেও ২০২৩-২৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় পাঁচ লাখ ২৫ হাজার ২৩৯ হেক্টরে। ২০২৪-২৫ সালে নেমে এসেছে চার লাখ ৩২ হাজার ১৫৩ হেক্টরে।
কৃষকরা কী বলছেন : কৃষকদের অনেকেই এখনো এই জাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারছেন না। কারণ এর দানার মান ঝরঝরে ও সুস্বাদু, বাজারে চাহিদাও আছে। তবে রোগ-বালাইয়ের কারণে আর আগের মতো নিশ্চিন্তে চাষ করা যাচ্ছে না। নরসিংদীর কৃষক শাহজাহান বলেন, ‘দুই বছর আগে এ জাতের ধানে চিটা হয়েছিল, কিন্তু পরের বছর ভালো হয়েছিল। তবে রোগের আশঙ্কায় কৃষি অফিস থেকে আমাদের এই ধান আবাদে এবং এই ধানের বীজ সংরক্ষণে নিরুৎসাহ করছে। আবার নতুন জাত নিয়েও শঙ্কায় আছি, যদি ফলন না হয়। তাহলে তো আরো ঝুঁকিতে থাকব। তাই বিষয়টি নিয়ে ভাবছি।’
বিকল্প জাত : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, কয়েক বছরের মধ্যে ব্রি ধান ২৮ ও ২৯-এর বীজ উৎপাদন কার্যক্রম শূন্যে নামিয়ে আনা হবে। বিকল্প হিসেবে কৃষকদের ব্রি ধান ৮৯, ৯২, ৯৭, ৯৯, বিনা ২৫ এবং নতুন উদ্ভাবিত ব্রি ধান ১১৩ ও ব্রি ধান ১১৪ চাষে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে ব্রি ধান ১১৪-কে বলা হচ্ছে ব্লাস্ট প্রতিরোধী ধান, যা কৃষকদের নতুন আশা জাগাচ্ছে। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ব্রি ধান ২৮ ও ব্রি ধান ২৯-এর এখনো ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এটি বোরো মৌসুমের হলেও কৃষকরা আউশ ও আমন মৌসুমেও আবাদ করছেন। এ কারণেই রোগ-বালাই আক্রমণ করছে। তবে ধীরে ধীরে এই ধানের আবাদ থেকে কৃষকরা সরে আসছেন। আর ব্রি ধান ২৯-এ রোগ-বালাই তেমন আক্রমণ না করলেও কম সময়ে ধান পাওয়া যায় এমন জাতগুলোই কৃষকরা বেশি বেছে নিচ্ছেন। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, কোনো জাত পাঁচ বছরের বেশি মাঠে রাখা উচিত নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে এবং দ্রুত কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। কৃষকরা নতুন কিছু নিতে দ্বিধা করেন, ঝুঁকি নিয়ে ভাবেন। তাই সম্প্রসারণকর্মীদের আরো সক্রিয় হতে হবে।