Image description

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দেশে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকছে। পাচারকারীরা আনছে পিস্তল, রিভলভার, রাইফেলসহ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। চট্টগ্রামের ব্যস্ততম সড়কে গত মঙ্গলবার প্রকাশ্যে আব্দুল হাকিম নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একইভাবে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে গুলিবিদ্ধ হয়ে হতাহত হন ১৭০ জন।
এদের মধ্যে মারা গেছে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে এসব অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও মানবাধিকার সংগঠন এইচআরএসএস সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

মানবাধিকার সংগঠন এইচআরএসএসের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে বিভিন্ন সহিংসতায় দেশে ১৭০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
এদের মধ্যে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি মারা গেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য এবং এইচআরএসএসের নিজস্ব অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা যায়।’

পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সূত্র বলছে, দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা পরিস্থিতি অবনতির বড় কারণ হলো সীমান্ত দিয়ে দেশে আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশ করা। মাঝেমধ্যে সীমান্ত এলাকায় কিছু অস্ত্রের চালান ধরা পড়লেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বেশির ভাগ অস্ত্র দেশে ঢুকে পড়ছে।

সূত্র জানায়, সীমান্তের অন্তত ১৭টি পথে দেশে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশ করছে। এর মধ্যে রয়েছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া, কুমিল্লা, রাজশাহীর গোদাগাড়ি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের রহনপুর, একই এলাকার সোনামসজিদ, আজমতপুর, বিলভাতিয়া, ঝিনাইদহের মহেশপুরের জুলুলি, সাতক্ষীরার কলারোয়ার তলুইগাছা ও শাঁকারা, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা এবং মেহেরপুর ও কুষ্টিয়ার সীমান্ত এলাকা। 

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় যৌথ বাহিনীর অভিযান। তবে কিছুদিন পর অভিযানটি কিছুটা শিথিল হয়ে পড়ে। এখন আবার নতুন করে গতি পাচ্ছে এ অভিযান।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, গত বছরের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসের পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছেন মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম। 

বাড়ানো হয়েছে র‌্যাবের অভিযান : গত মঙ্গলবার র‌্যাব মহাপরিচালক (অতিরিক্ত আইজিপি) এ কে এম শহিদুর রহমান জানান, র‌্যাবের অভিযানে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে জড়িত প্রায় ১৩ হাজার ১০০ জনকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

র‌্যাব সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত র‌্যাব ৪৮৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে রয়েছে র‌্যাবের লুট হওয়া ১৬৮টি অস্ত্রের ৯০টি এবং পুলিশের লুট হওয়া ২২৮টি আগ্নেয়াস্ত্র। এর বাইরে উদ্ধার করা হয়েছে ১৬৬টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র।

র‌্যাব সূত্র জানায়, গত ১৮ সেপ্টেম্বর বুয়েট শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনি হত্যা মামলার আসামি মুশফিক উদ্দীন টগরকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারে, তিনি সীমান্ত এলাকা থেকে অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহ করে রাজধানীতে এনে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করতেন। তাঁর কাছ থেকে ৩২ মিলিমিটারের একটি রিভলভারসহ বিভিন্ন অস্ত্রের সরঞ্জাম উদ্ধার করে র‌্যাব। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আরো অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাব ৩-এর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফায়েজুল আরেফীন।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য : পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে ও পরে দেশের ৬৬৪টি থানার মধ্যে ৪৬০টি থানা ও ১১৪টি ফাঁড়িতেও লুটপাট চালায় দুর্বৃত্তরা। ওই সময় থানা থেকে লুট হওয়া এক হাজার ৩৫০টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি।

মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম গত মঙ্গলবার পুলিশ সদর দপ্তরে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে, এসব অস্ত্র পার্বত্যাঞ্চল ও আরসার কাছে চলে গেছে। অস্ত্রগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।’ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যাদের কাছেই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

আট মাসে সীমান্তে বিজিবির ৬০ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার : বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত থেকে ৬০টি বিভিন্ন ধরনের অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। এ ছাড়া চার হাজার রাউন্ডের বেশি গুলিসহ শতাধিক হাতবোমা, হ্যান্ডগ্রেনেডসহ বিভিন্ন অস্ত্র ও সরঞ্জাম জব্দ করেছে।  দেশে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে তথ্য দিয়ে সহায়তা করার আহবান জানিয়ে বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম জানান, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করতে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অসাধু চক্র সীমান্ত দিয়ে দেশে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র আনার চেষ্টা করছে।

নির্বাচনের আগে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রে ফের বেপরোয়া ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’ : জামিনে মুক্ত সন্ত্রাসীরা অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে অপরাধ ঘটাতে পার বলে শঙ্কা রয়েছে। জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর অন্তত ছয়জন শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন হাজারীবাগ এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন, কিলার আব্বাস হিসেবে পরিচিত মিরপুরের আব্বাস আলী, মোহাম্মদপুরের ইমামামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালসহ ঢাকার অপরাধজগতের আরো দুই অন্যতম সদস্য নাঈম আমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু, পূর্ব রাজাবাজার এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী আসলাম হোসেন ওরফে সুইডেন আসলাম।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, জামিনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সহযোগিতায় দেশে নতুন করে সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। তাদের বেশির ভাগ কিশোর ও তরুণ সদস্য। তাদের হাতে অবৈধ রিভলভার, পিস্তলসহ রয়েছে অন্য অস্ত্রও।

গত ১ আগস্ট রাত সোয়া ৯টার দিকে রাজধানীর মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সামনে জামাল হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় জড়িত ‘শ্যুটার’ এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর সহযোগী। সে সাম্প্রতিক সময়ে আরো দুজনকে গুলি করে হত্যা করে বলে তথ্য পেয়ে তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। ওই ঘটনার এক দিন পর দারুসসালাম থানাধীন দক্ষিণ বিশিল এলাকায় তাহমিনা রহমান নামের এক নারীকে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।