Image description
 
 

মিষ্টির নাম ‘শিলটি’। আরও আছে ‘বালিশ’ ও ‘মাছ মিষ্টি’। মেলার প্রায় ৩০ পদের মিষ্টির মধ্যে এগুলো বিশেষ। মেলা উদ্বোধনের আগেই বসেছে এ রকম মিষ্টির প্রায় ৭০টি দোকান। প্রস্তুতি চলছে অন্যান্য দোকানপাট বসানোর। এই মেলার নাম ‘গুজিশহর মেলা’।

নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের গুজিশহর গ্রামে পৌষসংক্রান্তির দিন থেকে এই মেলা বসে। এবার কোনো কারণে মেলার উদ্বোধন হবে ২১ জানুয়ারি। তার আগেই মিষ্টির দোকানগুলোয় বেচাকেনার ধুম পড়ে গেছে। চলছে গম্ভীরা ও রাতভর বাউলগানের আসর।

মেলা কমিটির সূত্র জানায়, প্রায় ২০০ বছর আগে এই গ্রামে একজন সাধক এসে বসবাস শুরু করেন। তাঁর সম্পর্কে অনেক লোককথা প্রচলিত রয়েছে। মেলা কমিটির সাবেক সভাপতি নয়ন মণ্ডল বললেন, সাধু প্রেমগোসাই পৌষসংক্রান্তিতে এখানে পূজা–পার্বণের প্রবর্তন করেন। সেই সূত্র ধরেই এখানে প্রতিবছর মেলা বসে। এক দিন, দুই দিন হতে হতে এই মেলা এখন মাসব্যাপী চলে। মেলা উপলক্ষে সারা দেশ থেকে সাধু–সন্ন্যাসীরা পৌষসংক্রান্তিতে সাধুর আশ্রমে আসেন। তাঁরা রাতভর নামকীর্তন করেন। সেই সূত্র ধরে আশ্রম–সংলগ্ন প্রায় ৭০ বিঘা জমির ওপর মেলার আয়োজন করা হয়। মেলার উদ্বোধন পরে হলেও পৌষসংক্রান্তি থেকেই শুরু হয়ে গেছে মিষ্টির মেলা।
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় মেলা কমিটির উদ্যোগে গম্ভীরা গানের আয়োজন করা হয়। গম্ভীরা পরিবেশন করে রাজশাহীর কিষান গম্ভীরা দল। গম্ভীরায় নানার ভূমিকায় ছিলেন শিল্পী খুরশীদ আল মাহমুদ ও নাতির ভূমিকায় আতিকুর রহমান। মন্দিরের আটচালা ঘরে গম্ভীরা চলাকালে এলাকার নারী-পুরুষনির্বিশেষে দর্শকসারিতে মুগ্ধ হয়ে বসেছিলেন। মেলার ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, শুধু মিষ্টির দোকানগুলো মেলানো হয়েছে। শহর থেকে ডেকোরেটর নিয়ে একেকটি মিষ্টির দোকান জমকালোভাবে সাজানো হয়েছে। একটি দোকানে ১০০ থেকে প্রায় পৌনে ৩০০ জন পর্যন্ত গ্রাহকের একসঙ্গে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।

এ রকম একটি মিষ্টির দোকানের নাম ভাই ভাই মিষ্টান্ন ভান্ডার। দোকানের স্বত্বাধিকারী মো. হাবিবুর রহমান বললেন, ৩০ বছর ধরে এই মেলায় দোকান করছেন। গত বছর ৯৭ লাখ টাকার বেচাকেনা হয়েছে। তিনি এসেছেন নাচোলের সোনাইচণ্ডী থেকে। এখন ৩০ জন কর্মচারী নিয়ে শুরু করেছেন। মেলা উদ্বোধন হলে ৪৫ জন কর্মচারী কাজ করবেন। দোকানে প্রায় ৩০ পদের মিষ্টি রয়েছে। ২০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দামের মিষ্টি রয়েছে। আর বিশেষ মিষ্টির দাম ৮০০ টাকা, মানে ৪০০ টাকা কেজি। এই মিষ্টির নাম শিলটি। শুধু আকারেই বড় নয়, এই মিষ্টির সঙ্গে ছোট মিষ্টির স্বাদেরও পার্থক্য রয়েছে। শুরুতে এক কেজি থেকে দুই কেজি ওজনের পর্যন্ত মিষ্টি বানিয়েছেন। দোকানে বসে সবাই মিষ্টি দিয়ে লুচি খাচ্ছেন। এটাই এই মেলার ঐতিহ্য। প্রতিটি দোকানেই লুচি তৈরি করে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। দেখা গেল রাত প্রায় ১০টায়ও কারিগরেরা লুচি তৈরি করতে ব্যস্ত। তাঁরা বলছেন, ‘অভিজ্ঞতা বলছে, রাতেই সব লুচি বিক্রি হয়ে যাবে।’ মেলায় ছিলেন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক। তিনি বললেন, ‘মেলার রেওয়াজ অনুযায়ী প্রত্যেকেই বাড়ি ফেরার সময় মিষ্টি আর লুচি নিয়ে যান।’

সূর্যকান্ত দাসের দোকানে প্রায় ৩০ পদের মিষ্টি রয়েছে। একসঙ্গে ১০০ জনের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। তাঁর দোকানে বালিশ মিষ্টি খাচ্ছিলেন স্থানীয় নাকইল গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রহিম, জুয়েল রানা ও বাবু। তাঁরা বললেন, এই মিষ্টি খুব সুন্দর। তাঁরা মোগলাই পরোটা দিয়ে মিষ্টি খাচ্ছেন। একটি ছোট বালিশ মিষ্টি সাড়ে ৩০০ টাকা দিয়ে নিয়ে তাঁরা তিনজন খেতে বসেছেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ মিষ্টান্ন ভান্ডার হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারী তৈমুর রহমানের একই রকম মিষ্টির দোকান। তাঁর দোকানে একসঙ্গে পৌনে তিন শ গ্রাহকের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। ৪০ জন কর্মচারী দোকানে কাজ করছেন। তৈমুর বললেন, আট বছর বয়স থেকে তিনি মেলায় আসছেন। ভাই ভাই ওয়ান মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক আমিরুল ইসলাম স্থানীয় ব্যবসায়ী। তাঁর দোকানে একসঙ্গে ১৫০ জন একসঙ্গে বসে খেতে পারেন। দোকানে রয়েছে ২২ রকমের মিষ্টি। এই দোকানে বড় মিষ্টির মধ্যে রয়েছে বালিশ। দ্য নওগাঁ মিষ্টান্ন ভান্ডার হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক আবদুল কাদেরের দোকানের বড় মিষ্টির নাম মাছ মিষ্টি। আট টাকা কেজি যখন মিষ্টির দাম ছিল, তখন থেকে তিনি মেলায় মিষ্টির দোকান করেন। তাঁর বাবা আবদুল করিমও এই মেলায় মিষ্টির দোকান করেছেন।

সন্ধ্যার পর দেখা গেল, মন্দিরের সামনে একটি বটগাছের নিচে সাধু–সন্ন্যাসীরা আসন মেলে বসেছেন। সেখানে একটা কাঠের গুঁড়িতে ধিক ধিক করে আগুন জ্বলছে। সাধু নীরেন্দ্রনাথ প্রামাণিক বললেন, ‘আট দিন ধরে এই কাঠের গুঁড়িতে আগুন জ্বলবে। এ জন্য ৩০০ মণ কাঠ প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। এই কাঠের এক চিমটি ছাইও পরে পাওয়া যাবে না। মেলার পুণ্যার্থীরা সব ছাই নিয়ে চলে যাবেন। যে যা আশা করেন, তাঁর সেই আশা পূরণ হয়।’

ফেরার সময় দেখা গেল সাধু ক্ষিতীশ চন্দ্র সরকার শিঙ্গায় ফুঁক দিলেন। আর সাধু–সন্ন্যাসীরা গাইতে শুরু করলেন, ‘কে আনিলো রে? কোথায় ছিল রে মধুমাখা হরিনাম।’ মেলা থেকে ফিরতে ফিরতে মনে হলো, সত্যিই কোথায় ছিলে এত মানুষ, উদ্বোধনের আগেই তাঁদের কে নিয়ে এল মেলায়!