
স্বল্পমূল্যে উন্নত চিকিৎসা ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শের আশায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে নিউরো সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে রোগীরা আসেন রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে। কিন্তু এ সরকারি হাসপাতালে শয্যা সংকটের অজুহাতে রোগীদের ভয় দেখিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমন অভিযোগ উঠেছে নিউরো সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও আবাসিক সার্জন ডা. মো. বশীর আহম্মেদের বিরুদ্ধে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে দেরি হবে বা দ্রুত অস্ত্রোপচার না করলে রোগীর মৃত্যু হতে পারে- এমন ভয় দেখিয়ে শান্তিনগর, আগারগাঁও ও ধানমন্ডির বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে রোগীদের। সেখানে অস্ত্রোপচারের খরচ সরকারি খরচের দ্বিগুণ বা তারও বেশি।
একই ভাবে সূর্য বেগম নামে আরেক রোগীকে মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচারের জন্য একই চিকিৎসক বেসরকারি হাসপাতালে পাঠান ডা. বশীর। বলা হয়, দ্রুত অস্ত্রোপচার না করলে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেবে।
রোগীর মেয়ে হাফিজা আক্তার বলেন, অপারেশনের পর যে ওষুধ দেওয়া হয়েছে, তাতে উন্নতি না হয়ে উল্টো রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হলে আইসিইউতে নেওয়া হয়। অথচ কথা ছিল, অস্ত্রোপচারের পরদিনই বাড়িতে ফিরতে পারবেন রোগী। শুধু তাই নয়, রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়ার পর ডাক্তারকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। পরে হাসপাতালের ঊর্ধ্বতনরা যোগাযোগ করলে নার্সদের নতুন ওষুধ লিখে দেন ডা. বশীর। এমনকি একপর্যায়ে সুস্থ না হলেও রোগীকে জোর করে বাড়িতে পাঠাতে চান তিনি। তবে হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তাররা জানান, রোগী এ মুহূর্তে বাড়িতে গেলে সংক্রমণের নতুন করে অস্ত্রোপচার করা লাগতে পারে।
হাফিজা আরো বলেন, অনেক ধারদেনা করে চিকিৎসা করিয়েছি। অথচ এটি সরকারিতে হলে ভালো চিকিৎসার পাশাপাশি টাকাও অনেক কম লাগত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আগস্ট মাসেই শান্তিনগরের এক হাসপাতালেই অন্তত ১৭টি অস্ত্রোপচার করেছেন ডা. বশীর। এসব রোগী মূলত নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে ভর্তি হতে এসেছিলেন। পরে বশীর আহম্মেদের সুপারিশেই তারা সে হাসপাতালে গেছেন। এছাড়া আগারগাঁওয়ের গ্রিন হাসপাতাল ও ধানমন্ডির আরেকটি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত রোগী পাঠানোর প্রমাণ মিলেছে। এছাড়া ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ ও তার আশপাশের এলাকার রোগীদের জেলার একটি বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বলেন ডা. বশীর আহম্মেদ।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, বেসরকারি হাসপাতালে ভাগিয়ে নেওয়া এসব রোগীর কাছ থেকে অস্ত্রোপচারসহ চিকিৎসার যে খরচ ধরা হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা একই মানের হাসপাতাল ও সমপদের চিকিৎসকের দ্বিগুণ কিংবা তারও বেশি।
নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক জানান, সূর্য বেগমের যে অস্ত্রোপচারে এক লাখ ১০ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে, তা দ্বিতীয় সারির হাসপাতালে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায় করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে জহুরা খাতুনের অস্ত্রোপচারেও হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ খরচ।
এ ঘটনায় হাসপাতালের চিকিৎসকরা চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চিকিৎসকের এমন কর্মকাণ্ডে সরকারি হাসপাতালের প্রতি অনাস্থা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে সারা দেশে নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের যে সুনাম সেটি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। পাশাপাশি স্বল্পমূল্যের চিকিৎসায় রোগীদের খরচ হচ্ছে দ্বিগুণ বা তার চেয়েও বেশি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, চিকিৎসক সমাজের প্রতি বিরূপ প্রভাব তৈরি করছে। তবে বিষয়টিকে দুঃখজনক বললেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানায়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এদিকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ডা. মো. বশীর আহম্মেদ বলেন, রোগীরা নিজেরাই আমার চেম্বারে আসতে চান। আমি কাউকে জোর করে পাঠাই না।
তিনি আমার দেশকে বলেন, নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন আড়াই হাজার রোগী চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে বড় অংশই ভর্তিযোগ্য। কিন্তু প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ জনকে ভর্তি করা সম্ভব হয়। ফলে দিনের পর দিন রোগীদের অপেক্ষা করতে হয়। আর নিউরোসায়েন্সের ডাক্তার হওয়ায় আস্থা বেশি রোগীদের। ফলে কাউকে বাধ্য করে, ভয় দেখিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে পাঠাতে হয় না, বরং রোগী নিজ থেকে জানতে চায়, কোথায় আমি চেম্বার করি।
তিনি আরো বলেন, অস্ত্রোপচারের খরচ একেক রোগীর জন্য একেকরকম হয়। কেউ আমার চিকিৎসায় অবহেলার শিকার হয়েছেন- এমন অভিযোগ সঠিক নয়। অনেকগুলো ভালো কাজের পর দুয়েকটি খারাপ কিছু ঘটলে সেটিই আলোচনায় আসে। যাদের চিকিৎসা করাই, অবশ্যই তাদের আমি ফলোআপ করি। তারপরও আমার কিছুটা ভুল থাকতে পারে, এটা অস্বীকার করব না।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী গিয়াস উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাইলেও তিনি রাজি হননি। পরে গত ৬ অক্টোবর হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হয়, তাতেও সাড়া দেননি তিনি।
এ বিষয়ে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান আমার দেশকে বলেন, আস্থার কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীরা এ হাসপাতালে আসেন। রোগীদের যে চাপ, তা সামলাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। আমাদের হয়ত সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে, তবে এখান থেকে রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানো দুঃখজনক। আমাদের উচিত, রোগীদের সাহস দেওয়া, ধৈর্য ধরতে বলা। হয়ত এক সপ্তাহ কিংবা তারও বেশি সময় লাগছে। কিন্তু পরে ভর্তি হতে পারছে। কাজেই বাইরে পাঠানোর প্রয়োজন নেই।