
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই নাজুক। ক্ষণে ক্ষণে বদলে যায় পড়ালেখার ধরন। সবশেষ তিন বছরে তিনবার শিক্ষাপদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে। বারবার শিক্ষাক্রমে এমন পরিবর্তনে তীব্র মানসিক চাপে ভুগছে অধিকাংশ শিক্ষার্থী। অনেকে পড়ালেখায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে, অনেকে আবার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন বাবা-মা ও স্বজনরা।
মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলছেন, তারা প্রায়ই শিশু শিক্ষার্থী রোগী পাচ্ছেন। অভিভাবকরা তাদের কাউন্সিলিং করাতে চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হচ্ছেন। সবার সমস্যা প্রায় একই রকম। পড়ালেখার ধরন বদলে যাওয়ায় নতুন পদ্ধতিতে পড়তে অনীহা। পরিবার ও শিক্ষকরা পড়ালেখায় চাপ দেওয়া বিষণ্ন হয়ে পড়ছে শিশুরা।
পরিবর্তিত পদ্ধতিতে ধীরে ধীরে খাপ খাওয়ানোর জন্য শিক্ষক ও অভিভাবককে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে বলে মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে দায়িত্বপ্রাপ্তদেরও শিশুদের মনোজগতের বিষয়গুলো মাথায় রেখে শিক্ষাক্রম পরিবর্তনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) ‘বিপর্যয়-জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ তথ্য উঠে আসে। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে জাগোনিউজ২৪.কম। রাজধানীর মধ্যবাড্ডায় অবস্থিত জাগো নিউজ কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এর আয়োজন করা হয়।
গোলটেবিল বৈঠকে এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু ও কিশোর মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাদিয়া আফরিন বলেন, খুব অল্পসময়ের মধ্যে কারিকুলাম বারবার পরিবর্তন করলে তাদের মানিয়ে নিতে বড় সমস্যা হবে। অনেকে ঝরে পড়তে পারে। কেউ কেউ পড়ালেখায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার অভিজ্ঞতাও এটা। আমি অনেক বাচ্চা পেয়েছি যাদের বাবা-মা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসছেন যে, বাচ্চা এ পর্যন্ত ভালো রেজাল্টই করতো। কিন্তু যখন নতুন কারিকুলামে চলে আসলো, ও আর ওটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না। সে মনে করছে যে, আমি আর এটা হয়তো পারবো না। সে স্কুলে যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে বা পড়াশোনা থেকে দূরে সরে গেছে।
তিনি আরও বলেন, আমার মনে হয় এটা আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, যেখানে নীতি-নির্ধারকরা আছেন; সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারকরা শিক্ষার্থীদের এই যে মানসিক পরিবর্তনটা হয় যে, কারিকুলামের সঙ্গে; সুতরাং সেটার দিকে নজর রেখে এটা করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থীসহ সব অংশীজনের সঙ্গে আলাপ করে এটা নির্ধারণ করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের এমন মানসিক পরিস্থিতিতে বাবা-মা ও শিক্ষককে বড় ভূমিকা রাখতে হবে জানিয়ে ডা. সাদিয়া আফরিন বলেন, অবশ্যই সেখানে বাবা-মা ও শিক্ষকদের সাপোর্টিভ একটা রোল প্লে করতে হবে। শিক্ষকরা যেটা করতে পারেন যে, যখন পড়ানো হবে বা সিলেবাসটা দেওয়া হবে সেটা সম্পর্কে আগেই একটা ধারণা দেওয়া যে, এটা খুব কঠিন কিছু না বা এটা আগেও ছিল; তুমি পারবে এমনটা ধারণা দিতে হবে।
‘অভিভাবকরা যেটা করতে পারেন যে, তাদের যে আচরণগত অথবা মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, সেটা যদি সুপারভিশন করেন নিয়মিত এবং প্রথম দিকে খারাপ রেজাল্ট করলেও সেটাকে আরেকটু মোটিভেট করা। এসব জায়গাগুলোতে ফ্রম টিচারস অ্যান্ড প্যারেন্টস (শিক্ষক ও বাবা-মা) যদি সতর্কভাবে ভূমিকা রাখেন, তাহলে বেশি সমস্যা হবে না’ যোগ করেন এ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নীলুফার আখতার জাহান বলেন, আমার কাছে এক অভিভাবক তার সন্তানকে এনে বললেন, ও বলছে আগের পড়া সহজ ছিল, গ্রুপভিত্তিক শিখতে পেরেছি। এখনকার পড়া কঠিন, বুঝতে পারছি না। এজন্য বাচ্চাটা খাওয়া, স্কুলে যাওয়ায় অনাগ্রহ। এটা শিশুদের জন্য জটিল একটি ব্যাপার। আবার আরেকজন বললেন, মাঝে গ্যাপ যাওয়ায় তার ছেলেটা ক্লাস সিক্সে পড়েনি। সরাসরি সেভেনে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। এটাও ওই শিক্ষার্থীর জন্য চাপ। অভিভাবকদের এসব বিষয় সতর্ক থাকতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে যে আগের যে কারিকুলাম ছিল, তার চেয়ে এটা বেশি ভালো। এটা মেনে পড়লে তোমার ডিগ্রির মান বাড়বে, পড়ালেখায় তুমি আরও ভালো শিখবে। এ বিষয়গুলোও জরুরি। পাশাপাশি সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত কয়েকটি দেশের কারিকুলাম নিয়ে বিশ্লেষণ করে একটা মানসম্মত কারিকুলাম তৈরি করা, যা বৈশ্বিক মানদণ্ডে ঠিক থাকে। তাহলে শিক্ষার্থীরা এটা বুঝবে যে, তারা ভালো কিছু পড়ছে।’