
গুম হওয়া ব্যক্তিদের ভয়ঙ্কর সব বর্ণনা নিয়ে প্রামাণ্য তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। যেখানে উঠে এসেছে গোপন বন্দিশালা আবিষ্কার, গুম হওয়া ব্যক্তিদের নিষ্ঠুর জীবন-যাপনের চিত্র, নষ্টপ্রায় প্রমাণ সংগ্রহ এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারপ্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টির বিষয়গুলো। এই তথ্যচিত্র কমিশনের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে কী নাটকীয়ভাবে উদ্ধার করা হয় ব্যারিস্টার আরমানের আয়নাঘর। তার বর্ণনা অনুযায়ী সেই আয়নাঘরের অস্তিত্ব বিলীনের চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
প্রামাণ্যচিত্রের একটি অংশে দেখা যায় আট বছর গুম হয়ে থাকা ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাশেম আরমানের দেয়া তথ্যের অনুসন্ধান চালান কমিশনের কর্মকর্তারা। সেখানে কমিশন সদস্য ড. নাবিলা ইদ্রিস বলেন, ব্যারিস্টার আরমানের দেয়া বর্ণনা অনুযায়ী তদন্ত করতে যায় কমিশন সদস্যরা। কিন্তু আয়নাঘরের দায়িত্বে থাকা সেনাকর্মকর্তারা তাদের সঠিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করেননি। আরমানের ভাষ্যমতে তাকে যেখানে রাখা হতো সেখানে উঠতে প্রথমে কয়েকটি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হয়। ঠিক তার পরপরই কয়েকটি সিঁড়ি নিচে নামতে হয়। এরপর বামদিকে ছোট্ট একটি জায়গায় তাকে রাখা হয়। বর্ণনা অনুযায়ী র্যাব-ডিজিএফআইয়ের সেই আয়নাঘরে চলে যান কমিশনের সদস্য। কিন্তু আরমানের বর্ণনায় থাকা পায়ের নিচে টাইলস এবং বামদিকের সেই ছোট্ট ঘর খুঁজে পাওয়া যায় না। যেহেতু তার চোখ বাঁধা থাকতো তাই আরমানকে স্ক্র্যাচ আঁকতে বলা হয়। স্ক্র্যাচ এঁকে দিলে সেখানেও একই বর্ণনা আসে। তাহলে ছোট্ট আয়নাঘর, টাইলস গেল কোথায়? আরমান যেখানে টাইলসের কথা বলেছিলেন সেখানে সিমেন্টের প্লাস্টার এবং ছোট্টঘরের জায়গায় দেয়াল পাওয়া যায়।
নাবিলা বলেন, এরপর সেখানে দায়িত্বরত একজন সেনাকর্মকর্তাকে টাইলসের কথা জানতে চাওয়া হলে তিনি উত্তর দেন, ‘আমি তো বিল্ডিংয়ের মিস্ত্রি না।’ পরে কমিশনের অন্য সদস্যরা এক্সপার্টদের সাথে যোগাযোগ করেন। এক্সপার্টরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আরমানের বর্ণনার প্রমাণ পেয়ে যান। এরপর বামদিকের ওই দেয়ালে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করতেই বেরিয়ে আসে বামদিকের সেই ছোট্ট কুঠরি। সেখানে দেখা যায় নিচের টাইলস ভেঙে সিমেন্টের প্লাস্টার করে দেয়া হয়েছে। ভাঙা টাইলসের অংশ তখনো সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে আরমানকে আয়নাঘর থেকে বের করে ছোট্ট ওই ঘরের বাইরে দেয়াল দেয়া হয়েছিল যাতে কেউ আয়নাঘরের অস্তিত্ব বুঝতে না পারেন।
নাবিলকে আরো বলতে শোনা যায়, অন্যদের বর্ণনার সাথে ব্যারিস্টার আরমানের বর্ণনার কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। অন্যদের ২৪ ঘণ্টা হাত-চোখ বেঁধে না রাখলেও আরমানকে রাখা হতো। তাকে যখন রুম থেকে বের করা হতে তখন তিনি খালি পায়ে থাকতেন। যার কারণে নিচে টাইলস না প্লাস্টার সেটি বুঝতে পারতেন।
তদন্ত কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা কে এম খালিদ বিন জামান জানিয়েছেন, তথ্যচিত্রটিতে কমিশন কিভাবে গুমের শিকার ব্যক্তিদের সন্ধানে চেষ্টা চালিয়ে গেছে এবং সত্য উদঘাটনের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে, সে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। কমিশন পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা সংস্থা ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিণতি নির্ণয়ে নিরবচ্ছিন্ন অনুসন্ধান চালিয়েছে।
একইসাথে গুম হওয়া ব্যক্তিদের জন্য ‘ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স সার্টিফিকেট’ ইস্যুর সুপারিশ এবং সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ আইনের সংশোধনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর বিষয়ে নীতিগত পরামর্শ দিয়েছে কমিশন। এ তথ্যচিত্র শুধু অনুসন্ধানের বিবরণ নয়; এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রের প্রতি জন-আস্থা পুনর্গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য দলিল বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
কমিশনের প্রকাশ করা তথ্যচিত্রে এ ধরনের বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে যা অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তথ্যচিত্র দু’টির প্রকাশযোগ্য অংশ কমিশনের ওয়েবসাইটে রয়েছে এবং তা দেশের জনগণের জন্য সহজলভ্য।