
অর্থনীতির নানা সংকটের মাঝেও কিছুটা স্থিতিশীল ছিল রফতানি আয়, কিন্তু এবার সেই আশা ভাঙতে শুরু করেছে। টানা দুই মাস দেশের পণ্য রফতানি কমেছে—আগস্টে কমেছিল প্রায় ৩ শতাংশ, আর সেপ্টেম্বরে আরও বেড়ে ৪.৬১ শতাংশ হ্রাস হয়েছে। পাশাপাশি, সরকার পরিবর্তনের পর কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসা মূল্যস্ফীতিও ফের অনিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ঋণের উচ্চ সুদের প্রভাবে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, যার প্রতিফলন পড়েছে ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধিতেও। গত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে নেমে এসে আগস্টে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬.৩৫ শতাংশ—যা গত ২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ন্যূনতম। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে এখন ভজঘট পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
তলানির পথে অর্থনীতি
রাজনৈতিক অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণের সীমাবদ্ধতা, জ্বালানির ঘাটতি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নীতিমালা দেশের অর্থনীতিকে তলানির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
অর্থনীতির প্রধান সেক্টরগুলোতে বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন বিনিয়োগ স্থগিত রয়েছে। আন্তর্জাতিক ঋণমানের অবনতি, রাজস্ব ঘাটতি এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানেও সুখবর না থাকায় দেশের অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্বাচিত সরকার আসার পর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখা যায়নি। দেশের বড় উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা বিদেশে অবস্থান করছেন বা নতুন প্রকল্পে ঝুঁকি নিতে চাইছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগস্ট মাসের শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের মোট স্থিতি ১৭ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যা জুলাই মাসের তুলনায় সামান্য বেশি। তবে প্রবৃদ্ধির হার নামমাত্র পর্যায়ে নেমে এসেছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতির কারণে শিল্প খাতের সম্প্রসারণও ব্যাহত হচ্ছে।
সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক ভজঘট পরিস্থিতির মুখোমুখি। রফতানি আয় কমছে, ঋণের প্রবৃদ্ধি সীমিত, মূল্যস্ফীতি বাড়ছে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগ স্থবির।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্বাচিত সরকার আসার পর এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সম্ভব হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে।
রফতানি আয়: দুই মাসে পতন, উদ্বেগের সুর
চলতি বছরে দেশের রফতানি খাত কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে তা ধ্বংসাত্মক হারে হ্রাস পেয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগস্টে রফতানি আয় প্রায় তিন শতাংশ কমে দাঁড়ায়। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে আরও ৪.৬১ শতাংশ হ্রাস হয়।
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মোট রফতানি আয় ১২৩১ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫.৬৪ শতাংশ বেশি। তবে সাম্প্রতিক দুই মাসের পতন বাণিজ্য বিশ্লেষকদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়াবিহীন জুতা এবং প্লাস্টিক পণ্যের রফতানি কমেছে। অপরদিকে হিমায়িত খাদ্য, চামড়া ও প্রকৌশল খাতের রফতানি বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক, ইউরোপের চাহিদা হ্রাস এবং কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিই হ্রাসের মূল কারণ।
বিশেষজ্ঞরা আরও জানাচ্ছেন, “রফতানির ওপর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাপ স্পষ্টভাবে প্রভাব ফেলছে। নতুন বিনিয়োগের অভাবে অনেক কারখানা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে, যা রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।”
বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ২২ বছরে সর্বনিম্ন
রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং উচ্চ সুদের কারণে দেশের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ স্থবির। বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি জুন থেকে আগস্টের মধ্যে ৭ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। আগস্টে এটি দাঁড়িয়েছে ৬.৩৫ শতাংশ, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন বিনিয়োগ স্থগিত হয়েছে, পাশাপাশি চালু থাকা কারখানার কিছু অংশও বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম সীমিত হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বৃদ্ধি করায় ঋণ ব্যয় বেড়েছে। ফলে উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্পে ঝুঁকি নিতে অনীহা দেখাচ্ছেন।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “উচ্চ সুদ এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। নির্বাচনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিনিয়োগও বাড়বে।’’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালের পর এটাই সর্বনিম্ন ঋণ প্রবৃদ্ধি। গত বছরের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং সরকারের পরিবর্তনের পর থেকে বিনিয়োগ স্থবির। সরকারি ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম সীমিত বা স্থগিত হওয়ায় ব্যাংকগুলো প্রধানত সরকারি বন্ড ও বিলেই বিনিয়োগ করছে।
মূল্যস্ফীতি ফের ঊর্ধ্বমুখী
সেপ্টেম্বর মাসে নিত্যপণ্যের দাম আবারও বেড়ে গেছে। বিশেষ করে সবজি ও কাঁচামরিচের দাম কেজিতে ১০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৮.৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে, যা আগস্টের ৮.২৯ শতাংশের চেয়ে সামান্য বেশি।
খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে ৭.৬৪ শতাংশ, আর খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বেড়ে ৮.৯৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গ্রাম ও শহর—উভয় ক্ষেত্রেই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “বর্ষাকালের প্রভাব এবং সরবরাহ চেইনের বাধার কারণে দাম বেড়েছে। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য ভোক্তার হাতে পৌঁছানোর উদ্যোগ দাম বৃদ্ধিকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছে, ৭৪৯ ধরনের ৩৮৩ আইটেমের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) নির্ধারণ করা হয়। এতে খাদ্য, শিক্ষা, ইন্টারনেট ব্যয়, রেস্টুরেন্ট, বেভারেজ, তামাকজাত দ্রব্যসহ নানা খাতের তথ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
উচ্চ সুদ ব্যবসাবান্ধব নয়
বর্তমান ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ ব্যবসাবান্ধব নয় বলে মন্তব্য করেছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। তারা আগামী মুদ্রানীতিতে সুদের হার কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটে আনার দাবি জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএসহ ১৪ সদস্যের প্রতিনিধি দল। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্বাহী পরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন।
এফবিসিসিআইয়ের মহাসচিব আলমগীর বলেন, “বর্তমানে দেশে সুদের হার ১৪ শতাংশের ওপরে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা সাধারণত ১০-১১ শতাংশ মুনাফা করেন। এত উচ্চ সুদ ব্যবসাবান্ধব নয়। বিশ্ববাজারে টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন।”
তিনি আরও বলেন, “বিনিয়োগ বাড়াতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা ধরে রাখতে সুদের হার ধীরে ধীরে কমিয়ে এক অঙ্কে আনার অনুরোধ করেছি। গভর্নর জানিয়েছেন, নীতি সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে আসবে, যা আগামী মুদ্রানীতিতে প্রতিফলিত হবে।”
বৈঠকে ব্যবসায়ীরা করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বন্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন কমিটির মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানোর অনুরোধও জানান। রফতানিমুখী শিল্পের ব্যাংকিং জটিলতা সমাধানে বিশেষ কমিটি গঠনের প্রস্তাবও তারা তোলেন, যা গভর্নর ইতিবাচকভাবে অনুমোদন করেছেন।
সম্প্রসারণের পথে ফিরেছে শিল্প খাত
চলতি বছরের আগস্টে দেশের ‘পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স’ (পিএমআই) সূচক কিছুটা কমলেও সেপ্টেম্বর মাসে তা ৫৯.১-এ পৌঁছেছে, আগস্টে সূচক ছিল ৫৮.৩। সূচকের মান ৫০-এর ওপরে থাকলে খাত সম্প্রসারণশীল হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে, শিল্প খাত দ্রুত সম্প্রসারণের পথে ফিরেছে, কৃষি ও নির্মাণ খাতও সম্প্রসারণে রয়েছে। তবে সেবা খাতের সম্প্রসারণ তুলনামূলক ধীর।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ জানান, “নতুন বাজেট বাস্তবায়ন এবং অনুকূল আবহাওয়ার কারণে কৃষি ও নির্মাণ খাত সম্প্রসারণে এসেছে, তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব সেবা খাতকে ধীর রেখেছে।”
চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত বেড়েছে
রফতানি আয় ও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়ায় চলতি হিসাবের (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট) উদ্বৃত্ত বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস—জুলাই ও আগস্টে বাংলাদেশের চলতি হিসাবে ৪৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার উদ্বৃত্ত রেকর্ড হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই উদ্বৃত্ত ছিল ১৯১ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে দেশের পণ্য রফতানি বেড়েছে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। জুলাই–আগস্টে রফতানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। অপরদিকে আমদানি বেড়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ হারে এবং মোট আমদানি ব্যয় হয়েছে ১০ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার।
তবে প্রবাসী আয়ে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি চলতি হিসাবের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করেছে। রেমিট্যান্সের এই ইতিবাচক প্রবণতা সামগ্রিক বৈদেশিক খাতকে আরও শক্ত অবস্থানে এনেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, চলতি সময়ের আরেক গুরুত্বপূর্ণ সূচক আর্থিক হিসাবেও (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) উন্নতি হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ, ঋণ ও বৈদেশিক সম্পদ–দায় সংক্রান্ত লেনদেনে ঘাটতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই–আগস্টে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি নেমে এসেছে মাত্র ৫৩ মিলিয়ন ডলারে, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।
সব মিলিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের শুরুতে দেশের বৈদেশিক খাত আগের চেয়ে স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। গত অর্থবছরেই (২০২৪-২৫) তিন বছর পর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের মোট পরিশোধ হিসাব (ব্যালান্স অব পেমেন্টস) উদ্বৃত্তে ফেরে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রবাসী আয় বৃদ্ধি, রফতানি প্রবৃদ্ধি, নমনীয় বিনিময় হার এবং সরকারি রাজস্ব ও মুদ্রানীতির কৌশলগত কঠোরতা এই ইতিবাচক প্রবণতার মূল কারণ।