Image description

আগামী ১৬ অক্টোবর এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করতে যাচ্ছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। এর মধ্য দিয়ে অটোপাস, সংক্ষিপ্ত সিলেবাস আর সাবজেক্ট ম্যাপিং পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে দেশের অ্যাকাডেমিক পরীক্ষা। তবে উত্তরপত্র দেখায় কড়াকড়ি এবং কাউকে ‘গ্রেস মার্কস’ না দেওয়ার কারণে এবার জিপিএ-৫ ও পাসের হার কমতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ অবস্থায় ‘খারাপ ফল’ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় কতটা প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা। তবে অনেকেই বলছেন, জিপিএ-৫ বা ‘এ’ প্লাস উচ্চশিক্ষায় প্রবেশে তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলগুলোয় ভর্তির ক্ষেত্রে এইচএসসিতে সুনির্দিষ্ট ফলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। চাহিদার তুলনায় কম জিপিএ পেলে আবেদনের সুযোগই থাকে না প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এর মধ্যে সবচেয়ে কঠোর পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি আবেদনের ক্ষেত্রে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫-এর মধ্যে ৫-ই পেতে হয়। এ ছাড়া সুনির্দিষ্টভাবে উচ্চতর গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন বিষয়ের প্রতিটিতে জিপিএ-৫ পেতে হয়। একই সঙ্গে এসএসসিতেও গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নসহ বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫-এর মধ্যে ন্যূনতম ৪ থাকতে হয়।

ভর্তিতে মেডিকেলের ক্ষেত্রে প্রার্থীকে এসএসসি, এইচএসসি ও সমমানের দুটি পরীক্ষায় মোট জিপিএ কমপক্ষে ৯ হতে হবে। তবে এককভাবে কোনো পরীক্ষায় জিপিএ ৩.৫০-এর কম হলে আবেদনের অযোগ্য হবেন। এর মধ্যে এইচএসসিতে অবশ্যই জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন থাকতে হবে। আবার জীববিজ্ঞানে ন্যূনতম গ্রেড পয়েন্ট ৪ থাকতে হবে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাবিতে বিজ্ঞান ইউনিটের জন্য এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার (চতুর্থ বিষয়সহ) জিপিএর যোগফল ন্যূনতম ৮ এবং আলাদাভাবে জিপিএ ৩.৫, কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটের জন্য জিপিএ-দ্বয়ের যোগফল ন্যূনতম ৭.৫ এবং আলাদাভাবে জিপিএ ৩, ব্যবসায় শিক্ষা ইউনিটের জন্য জিপিএ-দ্বয়ের যোগফল ন্যূনতম ৭.৫ এবং আলাদাভাবে জিপিএ ৩.০ এবং চারুকলা ইউনিটের জন্য জিপিএ-দ্বয়ের যোগফল ন্যূনতম ৬.৫ এবং আলাদাভাবে জিপিএ ৩.০ থাকতে হবে।

সবচেয়ে কঠোর পদ্ধতি বুয়েটে। এখানে ভর্তি আবেদনের ক্ষেত্রে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫-এর মধ্যে ৫-ই পেতে হয়। এ ছাড়া সুনির্দিষ্টভাবে উচ্চতর গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন বিষয়ের প্রতিটিতে জিপিএ-৫ পেতে হয়। একই সঙ্গে এসএসসিতেও গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নসহ বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫-এর মধ্যে ন্যূনতম ৪ থাকতে হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনামূলক হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ৪৭ হাজার ২৮৬ জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জনে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩.৪২ গুণ বেশি। পরের বছর জিপিএ-৫ বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ জনে। এরপর ২০২২ সালে ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ এবং ২০২৪ সালে ৭৮ হাজার ৫২১ জন জিপিএ-৫ পান। আর গত বছর পেয়েছিলেন ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। এর মধ্যে সর্বশেষ ২০১৯ সালে পূর্ণ সিলেবাস ও পূর্ণ নম্বরে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পরের বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। ওই বছর জেএসসি এবং এসএসসির ফলের ভিত্তিতে সাবজেক্ট ম্যাপিং পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের এইচএসসির ফল নির্ধারণ করা হয়। এতে সবাই উত্তীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি জ্যামিতিক হারে বাড়ে জিপিএ-৫-এর সংখ্যা। তবে এ বছর স্বাভাবিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি খাতা মূল্যায়নে কড়কাড়ি ও গ্রেস মার্কস না দেওয়ার কারণে পাস ও জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা কমতে পারে। এসএসসি পরীক্ষাতেও এ পরিস্থিতি দেখা গেছে।

 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ কিংবা ‘ভালো রেজাল্ট’ ভর্তি পরীক্ষায় তেমন একটা প্রভাব রাখে না। ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণ করে প্রতিবছরেই অসংখ্য শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অর্থাৎ যারা ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার, তারা উত্তীর্ণ হয়ে যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেই ভর্তি হন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্প্রতি শিক্ষা উপদেষ্টার বক্তব্যেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। গত ৩১ মে শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে এক মতবিনিময় সভায় শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, ‘বর্তমানে ‘এ’ প্লাস ও গোল্ডেনে সয়লাব হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ৯০ শতাংশই ফেল করছেন। ফলে শিক্ষার্থীরা যে নম্বর পাওয়ার যোগ্য, সেটাই তাকে দেওয়া হবে। খয়রাতি নম্বর দেওয়া হবে না। আমরা সস্তা জনপ্রিয়তা নেওয়ার জন্য সেটা করব না।‘

এক্ষেত্রে বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানিয়ে নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন অনেকে। সবার ক্ষেত্রেই একই অবস্থা হওয়ায় এসব মাথায় না নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। রাজধানীর একটি কলেজের প্রভাষক মো. আতিকুর রহমান বলেন, ‘এসএসসির মতো অন্যবারের চেয়ে এবার এইচএসসিতেও পাস কমতে পারে বলে ধারণা করছি। তবে এই পরীক্ষাই যে জীবনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দেবে, বিষয়টি এমন নয়। এবার পুরোপুরি মেধার ভিত্তিতে ফলাফল প্রকাশ করায় সবার প্রকৃত অবস্থাটা জানা যাবে। সে অনুযায়ী, পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য তারা প্রস্তুতি নিলে ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পারবে বলে আশা করি।’

এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নেওয়া একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন ও রমজানের কারণে এবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা এগিয়ে নিয়ে আসছে বলে জানা যাচ্ছে। আবার এইচএসসি পরীক্ষার খাতা দেখায়ও কড়াকড়ি আছে। এতে তারা কিছুটা চাপে আছেন সত্য। তবে এমন অবস্থা দু-একজনের নয়, সবার। ফলে সার্বিক বিবেচনায় এটি তাদের ওপর তেমন প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন তারা।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বেশি সময়ের প্রয়োজন নেই। তিন মাস পড়াশোনার জন্য যথেষ্ট সময়। আগে যেভাবে অ্যাডমিশনের প্রশ্নপত্র হতো যে ‘আউট অব সিলেবাস’, এখন এমন নয়। সব কটি পাঠ্যবইনির্ভর হয়ে গেছে। সাধারণ জ্ঞান একটু বাইরে থেকে আসে। এটার জন্য এভারেজ সবারই  প্রস্তুতি থাকে। ফলে তিন মাসের প্রস্তুতিতে ভর্তি অবশ্যই সম্ভব। —আবিদুল ইসলাম খান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে ছাত্রদলের প্রতিনিধিত্ব করা আবিদুল ইসলাম খান বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের একজন জনপ্রিয় শিক্ষক। জানতে চাইলে তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের যে যোগ্যতা দিয়ে রাখে, এতে এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ফরম সংগ্রহ করতে পারবেন। এইচএসসির সামগ্রিক ফলে জিপিএ কম হলেও ভর্তির ক্ষেত্রে খুব একটা প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। কারণ ঢাবির ভর্তি পরীক্ষায় এখন এসএসসি ও এইচএসসির ফলের ওপর ২০ নম্বর থাকে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নিয়মও নেই।

সময় স্বল্পতার বিষয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির যে সময়টা থাকে, এটা আসলে অনেক বেশি সময়ের প্রয়োজন নেই। তিন মাস পড়াশোনার জন্য যথেষ্ট সময়। আগে যেভাবে অ্যাডমিশনের প্রশ্নপত্র হতো যে ‘আউট অব সিলেবাস’, এখন এ রকম না। সব কটি পাঠ্যবইনির্ভর হয়ে গেছে। সাধারণ জ্ঞান একটু বাইরে থেকে আসে, এটার জন্য এভারেজ সবারই  প্রস্তুতি থাকে। ফলে তিন মাসের প্রস্তুতিতে ভর্তি অবশ্যই সম্ভব। তবে ডিসেম্বরের শেষ বা জানুয়ারির শুরুর দিকে যেন পরীক্ষাটা নেওয়া হয়। ফল নির্বাচনের আগে প্রকাশ করা হলো। এতে খুব বড় অসুবিধা হবে না।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মো. সুমন আলী এইচএসসি পরীক্ষায় ৩.৮৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ভর্তি পরীক্ষার সময় অক্লান্ত পরিশ্রমের পর যবিপ্রবি গণিত বিভাগে ভর্তির সুযোগ পান তিনি। এইচএসসির ফল কেমন প্রভাব ফেলে—এমন প্রশ্নে সুমন আলী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘মানুষ মনে করে ভাগ্যে যা লেখা থাকে সেটাই হয়, কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল যে কেউ যদি পরিশ্রম করে, তাহলে তার পরিশ্রম মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব। আমি এইচএসসি দুবার দিয়েছি। প্রথমবার ৩.৪২ আর দ্বিতীয়বার ফল আসে ৩.৮৩, ৪ পয়েন্টও পার করতে পারিনি। আমি ২৬তম পরীক্ষা দেওয়ার পর যবিপ্রবিতে টিকেছি। আমার সিরিয়াল ছিল ১৪৩। গণিত পড়ার ইচ্ছা ছিল, তাই এ বিভাগেই ভর্তি হই।’