
এক বিকেলে রাউজানে রক্তে লাল হয়ে থাকা গাড়ির ভেতরে পড়ে ছিল এক বৃদ্ধ নেতার নিথর দেহ। তার গায়ে তখনো লেগে ছিল সাদা চেকের পাঞ্জাবি। গাড়িতে দলের পতাকার ছাপ। বছরের পর বছর মিটিং-মিছিলের ভাঁজে ভাঁজে মলিন হয়ে যাওয়া প্রতীক। নাম তার মোহাম্মদ আবদুল হাকিম (৬৫)। স্থানীয়ভাবে পরিচিত ছিলেন রাউজান দক্ষিণের বিএনপি রাজনীতির এক পুরোনো মুখ হিসেবে। সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি নেতা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
কিন্তু মৃত্যুর পর তার পরিচয় নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। কেন্দ্রীয় বিএনপির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, নিহত ব্যক্তি দলের কেউ নন। অন্যদিকে স্থানীয় বিএনপি নেতারা বলছেন, যিনি মৃত্যুর আগের দিনও বিএনপির পতাকা নিয়ে ছিলেন, তাকে অচেনা বলাটা অমানবিক।
রাউজানের মদুনাঘাট এলাকায় গত মঙ্গলবার বিকেলে গুলি করে হত্যা করা হয় হাকিমকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, হামলাকারীরা মুখোশ পরা ছিল। ঘটনার পর আবদুল হাকিমের ভাই মুহাম্মদ পারভেজ বলেন, আমার ভাই দীর্ঘদির বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ভাইয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কারও শত্রুতা ছিল না। তিনি গিয়াস উদ্দিন কাদেরের অনুসারী। কী কারণে তাকে হত্যা করা হলো তা তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির দাবি করেন পারভেজ।
আব্দুল হাকিম রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের পাঁচখাইন গ্রামের বাসিন্দা। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। লাশ বাড়িতে নেয়ার পর পরিবারের সদস্যরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, হাকিম সারা জীবন বিএনপি করেছেন, দলীয় অনুষ্ঠানে মঞ্চ বানিয়েছেন। মাইক ধরেছেন। পোস্টার লাগিয়েছেন। কিন্তু এখন যখন মারা গেছেন, তখন তাকে কেউ কেউ চিনে না।
এমন শোক-অভিমান যেন বাংলাদেশের রাজনীতির চিরচেনা প্রতিচ্ছবি-‘জীবিত থাকলে কর্মী, মৃত হলে অচেনা মানুষ।’
১৯৯১ সাল থেকে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, ১৯৯১ সাল থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আবদুল হাকিম। মধ্যখানে নিষ্ক্রিয় থাকলেও ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবারও সক্রিয় হন বিএনপির রাজনীতিতে। গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও দলীয় কর্মসূচিতে একাধিকবার দেখা গেছে আবদুল হাকিমকে। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মতে, তিনি ছিলেন গিয়াস কাদেরের ঘনিষ্ঠ অনুসারী এবং রাউজান কর্ণফুলি এলাকায় তার নির্দেশে সংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
এমনকি হত্যার প্রতিবাদে রাতেই রাউজান উপজেলায় চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক অবরোধ করেন দলের নেতা-কর্মীরা। হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবি করে রাত সাড়ে আটটা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা রাউজান সদরের মুন্সির ঘাটা ও সূর্য সেন চত্বর, জলিলনগরসহ পাঁচ থেকে ছয়টি স্থানে অবরোধ করা হয়। অবরোধের কারণে দুই পাশে কয়েক শ যানবাহন আটকে পড়ে। অবরোধ চলাকালে টায়ার জ্বালিয়ে সড়কে অবস্থান নেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসে তাদের আশ্বস্ত করে সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়।
নিহত আব্দুল হাকিমকে অস্বীকার করেছে কেন্দ্রীয় বিএনপি। বুধবার সকালে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৭ অক্টোবর হাটহাজারী উপজেলার মদুনাঘাট এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতিকারীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে গুলিতে আব্দুল হাকিম নামে একজন খুন হয়েছেন। এই সহিংস ঘটনার সাথে রাজনীতি বা বিএনপির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। নিহত ব্যক্তি ও দুষ্কৃতিকারীদের কেউই বিএনপির নেতাকর্মী নয়।
এদিকে আব্দুল হাকিমকে অস্বীকার করায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপির বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠেছে। অনেকেই বলছেন, মৃত্যুর পর যে দল তার কর্মীর লাশটি বহন করার হিম্মত রাখে না। সে দল জনগণের দল নয়। নিহত আব্দুল হাকিমের পূরণ করা বিএনপির প্রাথমিক সদস্য পদের ফরম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাসছে। ৮০৮৮০১ ক্রমিক নংয়ের ওই ফরমে লেখা রয়েছে, কেন্দ্রীয় দপ্তর প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহ ফরম। আমি মোহাম্মদ আব্দুল হাকিম, পিতা মো. আলী মদন, ১৪ নম্বর বাগোয়ান ইউনিয়ন। ওই ফরমে আরো বেশকিছু তথ্য রয়েছে।
রাউজান উপজেলা বিএনপি যুগ্ম আহবায়ক নুরুল হুদা চেয়ারম্যান বলেন, তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন। প্রশাসনের নিকট আবেদন এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন।
কিন্তু এই বিষয়ে জানতে গিয়াস কাদের চৌধুরীকে বারবার কল দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
রাউজান উপজেলার রাত আসলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে মানুষ। এ উপজেলায় গত ১১ মাসে গুলিতে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৪ জন। এদের প্রায় সবাই বিএনপি-ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কেউ স্থানীয় পর্যায়ের নেতা, কেউ ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মী। প্রতিটি হত্যাই ঘটেছে প্রকাশ্যে, অন্ধকার রাতে বা ভোরের দিকে। কোনো ঘটনায় এখনো বিচার হয়নি।
স্থানীয় এক প্রবীণ বিএনপি নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সবাই জানে এই হত্যাগুলো দুই পক্ষের রাজনৈতিক শত্রুতার ফল। গিয়াস কাদেরের অনুসারীরা একদিকে, গোলাম আকবরের অনুসারীরা আরেকদিকে। কিন্তু কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারে না। বললেই পরের লাশ হতে হয়। তিনি বলেন, রাউজানে এখন এমন অবস্থা এখানে রাজনীতি মানে বন্দুক, মামলা আর অন্ত্যেষ্টি।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল) তারেক আজিজ বলেন, আব্দুল হাকিমের হত্যার সময় মদুনাঘাট তদন্তকেন্দ্রের টহল পুলিশ সদস্যরা নজুমিয়া হাটে ছিলেন। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হয়। কিন্তু গুলির শব্দের কারণে ঘটনাস্থলের আশপাশে সড়কে যানজট ছিল। তা ছাড়া গুলি করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সন্ত্রাসীরা পালিয়ে গেছেন। যে কারণে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গেলেও আসামিদের ধরতে পারেনি। অপরাধ যারা করছেন তারা কেউ পার পাবেন না।