Image description
 

বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টসের (বিআরআইসিএম) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালা খানের নিয়োগে অনিয়ম, গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি ও পিএইচডি ডিগ্রিতে জালিয়াতির অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশে কর্তৃপক্ষ তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।

 

তবে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করে বর্তমানে স্বপদেই বহাল আছেন মালা খান। জানা গেছে, আসন্ন ২৮ অক্টোবর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এই রিটের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে, যা তার ভবিষ্যতের নিয়তি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিসিএসআইআরের মহাপরিচালক অনুপম বড়ুয়া জানান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি মালা খানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোকে সত্য প্রমাণিত করেছে। সেই প্রেক্ষিতে পরিচালনা বোর্ড তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়। তবে রিটের কারণে আদেশ স্থগিত থাকায় তিনি এখনও দায়িত্বে আছেন।

 

এ বিষয়ে মালা খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলে কল কেটে দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে পাঠানো হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায়ও কোনো উত্তর মেলেনি।

 

অননুমোদিত পিএইচডি ও নিয়োগ জালিয়াতির অভিযোগ

তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, অননুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়া ও যোগ্যতার ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও প্রতারণার মাধ্যমে বিআরআইসিএমে চাকরি নিয়েছেন মালা খান।
গত বছরের ১০ ডিসেম্বর পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে গঠিত তদন্ত কমিটি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পায়। এরপর ১৫তম বোর্ড সভায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত এবং বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়, যা কার্যকর করা হয় ২৫ মে প্রকাশিত অফিস আদেশে।

সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু পরিষদ সায়েন্স ল্যাব শাখার সভাপতি মালা খান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সুবাদে যোগ্যতার ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও ২০২২ সালে চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার পদে নিয়োগ পান।

বিসিএসআইআর ও বিআরআইসিএমের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মালা খানের দ্রুত উত্থান ঘটে। তারা বলেন, “আওয়ামী আমলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অন্যতম সুবিধাভোগী কর্মকর্তা ছিলেন তিনি।”

 নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম

২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে অন্তত ১৪ বছরের প্রথম শ্রেণির গবেষণার অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু মালা খানের অভিজ্ঞতা ছিল মাত্র ৮ বছর ৭ মাস, ফলে যাচাই-বাছাই কমিটি তার আবেদন বাতিলের সুপারিশ করে।
তবু প্রভাবশালী মহলের চাপে তার আবেদন পুনরায় গৃহীত হয় এবং বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই ইয়াফেস ওসমানের নির্দেশে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

বিসিএসআইআর বিজ্ঞানী সংঘ এ নিয়োগের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে, যা এখনও চলমান। জানা যায়, তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে অর্থ প্রদানের মাধ্যমে মামলাটি স্থগিত রাখতে সক্ষম হন মালা খান।

 ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির প্রমাণ

তদন্তে উঠে এসেছে, মালা খান যে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তা ‘আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি’ নামের একটি অননুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি স্পষ্টভাবে জানিয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রির কোনো আইনি বৈধতা নেই।
২০২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর ইউজিসি ও ২০২৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে মালা খানের ডিগ্রি ‘অবৈধ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

এছাড়া তার পিএইচডি সুপারভাইজর ড. এস. এম. ইমামুল হক, যিনি তখন বিসিএসআইআরের চেয়ারম্যান ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নন, অথচ থিসিসে তাকে তেমনভাবে উপস্থাপন করা হয়। তার সহ-সুপারভাইজর ছিলেন স্বামী কেএম মোস্তফা আনোয়ার, যার রসায়নে কোনো স্বীকৃত ডিগ্রি নেই।

তদন্তে জানা গেছে, মালা খানের থিসিস ২০০৮–০৯ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ বরাদ্দ প্রকল্পের প্রতিবেদন থেকে হুবহু নকল, এমনকি এতে ক্রোয়েশিয়ার এক মেট্রোলজি রিপোর্টের তথ্য কপি-পেস্ট করা হয়েছে।

দুর্নীতি ও বিতর্ক

ভুয়া ডিগ্রি ও অনিয়মিত নিয়োগের পর মালা খান বিআরআইসিএমের মহাপরিচালক হয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন, এমন অভিযোগ রয়েছে দুদক ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে।
তাছাড়া অফিসে একটি ‘গোপন কক্ষ’ তৈরি করে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন তিনি। যদিও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কক্ষটি আসলে গোপন ছিল না অফিসের অনেকেই বিষয়টি জানতেন।