
নিজ দেশের নাগরিকের আবাসনসংকট বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদেশি নাগরিকের বাড়ি কেনায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে কানাডা। ২০২৩ সালে জারি হওয়া নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল আছে।
গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে অটোয়া কর্তৃপক্ষ আরও স্পষ্ট করে জানিয়েছে, এ নিষেধাজ্ঞা শুধু শহরাঞ্চলের বাসস্থানগুলোর জন্য প্রযোজ্য হবে। তবে গ্রীষ্মকালীন কটেজগুলোর মতো বিনোদনমূলক সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়।
বাড়ির মূল্য বেশি হওয়ায় অনেক কানাডিয়ান বাড়ি কিনতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় ২০২১ সালের নির্বাচনি প্রচারে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দুই বছরের জন্য সাময়িক এ প্রস্তাব দেন। কিন্তু পরে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
দেশটির লিবারেল পার্টি জানায়, কানাডায় বাড়ি কেনাটা মুনাফাকারী, ধনী ব্যবসায়ী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এতে অব্যবহৃত ও খালি পড়ে থাকা বাড়িগুলোর দামও আকাশছোঁয়া হয়েছে। বাড়িগুলো মানুষের জন্য, বিনিয়োগকারীদের জন্য নয়।
এ নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারকারীরা এখন সেখানে বাড়ি কিনতে পারছে না। বাড়ি কিনতে না পারলেও কানাডায় অর্থ পাচার বন্ধ হয়নি। কানাডায় অর্থ পাচার এবং সন্দেহভাজন আর্থিক লেনদেন দেখভালের দায়িত্বে থাকা ফেডারেল সংস্থা ফিনট্যারকের তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরে (২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত) বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা গেছে কানাডায়। এর মধ্যে মাত্র ২৮ কোটি টাকা গেছে বৈধ পথে; যা মূলত সেখানে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি। বাকি টাকা সন্দেহমূলক। কারা এ অর্থ পাঠাল তার একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় সাম্প্রতিক এক ঘটনায়।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সদ্যনিয়োগ বাতিল হওয়া প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলামের বিরুদ্ধে উঠে এসেছে অর্থ পাচার, কর ফাঁকি ও সম্পদ গোপনের ভয়াবহ অভিযোগ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীন আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে প্রকাশ পেয়েছে, তিনি ব্যাংক, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ক্রেডিট কার্ডসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লেনদেন করেছেন; এর বড় অংশই আয়কর রিটার্নে উল্লেখ নেই। বিশেষত তিনি তাঁর মেয়ে নোভা ইসলামকে কানাডায় বিপুল অঙ্কের টাকা পাঠিয়েছেন, যার বড় অংশই কর নথিতে গোপন করে পাচার করেছেন।
আয়কর গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ইস্টার্ন ব্যাংকে শাহীনুল ইসলামের নামে থাকা একটি হিসাবে ব্যাপক অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, তাঁর মেয়ের কাছে কানাডায় মাত্র ১০ লাখ টাকা পাঠিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকের হিসাব ঘেঁটে দেখা গেছে, মেয়েকে পাঠানো অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ ৮০ হাজার ৯৩৫ টাকা। এর ফলে প্রমাণিত হয়েছে, প্রায় ১ কোটি ৮০ হাজার ৯৩৫ টাকা তিনি আয়কর ফাইলে গোপন করে বিদেশে পাচার করেছেন।
এনবিআর কর্মকর্তাদের মতে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরেও তিনি হুন্ডি বা অনানুষ্ঠানিক পথে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার করে থাকতে পারেন। কানাডায় মেয়ের পড়াশোনা ও জীবনযাপনের খরচ মেটানোর আড়ালে চলেছে এ অর্থ লেনদেন।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক এবং ইস্টার্ন ব্যাংকে শাহীনুল ইসলামের নামে একাধিক হিসাব রয়েছে। এসব হিসাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।
২০১৮-১৯ অর্থবছর : ৩২ লাখ ৬১ হাজার ১২০ টাকা
২০১৯-২০ অর্থবছর : ৪২ লাখ ৬৯ হাজার ৮৬৫ টাকা
২০২০-২১ অর্থবছর : ৬৭ লাখ ৪৪ হাজার ৯৫৭ টাকা
২০২১-২২ অর্থবছর : ১ কোটি ১ লাখ ২৫ হাজার ৪৬৭ টাকা
২০২২-২৩ অর্থবছর : ৭৩ লাখ ২ হাজার ১০০ টাকা
২০২৩-২৪ অর্থবছর : ৯৩ লাখ ১৬ হাজার ২৯২ টাকা
এ ছাড়া মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বিকাশ ও রকেটে তাঁর নামে বিশাল অঙ্কের লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও এসব লেনদেনের কোনো অংশই আয়কর রিটার্নে সঠিকভাবে উল্লেখ নেই।
শাহীনুল ইসলামের স্ত্রীর নামে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী, রমনায় রয়েছে ১ হাজার ১০৫ স্কয়ার ফুট আয়তনের একটি ফ্ল্যাট। আয়কর রিটার্নে এর মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৩১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। অথচ বাস্তবে ওই ফ্ল্যাটের বাজারমূল্য ৭১ লাখ টাকার বেশি। স্ত্রীর কোনো বৈধ আয় না থাকলেও তাঁর নামে এ ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে।
অন্যদিকে রাজধানীর প্রগতি সরণিতে শ্বশুর আলাউদ্দিন খানের নামে রয়েছে একটি ফ্ল্যাট, যেখানে বর্তমানে বসবাস করছেন শাহীনুল ইসলাম। এর দলিলমূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৪ লাখ টাকা, অথচ প্রকৃত মূল্য দাঁড়ায় ৩০ লাখ টাকার বেশি। শ্বশুরের নামে নিবন্ধিত হলেও এ সম্পত্তির অর্থ যে আসলে শাহীনুল ইসলামের অবৈধ আয়ের ফল, তা নিশ্চিত হয়েছে গোয়েন্দাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, শ্বশুরের নামে টিআইএন নম্বর থাকলেও তিনি কখনো আয়কর রিটার্ন দাখিল করেননি।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা শাহীনুল ইসলামের নামে একটি ব্যাংকে ২০ লাখ টাকার এফডিআর খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু কর রিটার্নে এর কোনো উল্লেখ নেই। এ ছাড়া তাঁর নামে একাধিক ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড পাওয়া গেছে, যেখানে বিপুল অঙ্কের লেনদেনের তথ্য উঠে এসেছে। কর্মকর্তাদের ধারণা, এসব লেনদেনও অবৈধ অর্থ ব্যবহার করে করা হয়েছে।
একজন কর গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ‘শাহীনুল ইসলামের ব্যাংক হিসাব, ক্রেডিট কার্ড, নগদ, বিকাশ ও রকেটের লেনদেনে যে বিপুল অঙ্কের অর্থ লেনদেনের প্রমাণ মিলেছে, তা তাঁর আয়কর ফাইলের সঙ্গে তুলনা করলে বিরাট অসংগতি ধরা পড়ে। মেয়ে কানাডায় পড়াশোনা করলেও তাঁর কাছে যে বিপুল অঙ্কের টাকা পাঠানো হয়েছে, তা রিটার্নে দেখানো হয়নি। অর্থাৎ এটি সরাসরি টাকা পাচারের প্রমাণ।’ তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরেও হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে থাকতে পারে। বর্তমানে এসব লেনদেনের উৎস খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নারীঘটিত একটি কেলেঙ্কারির কারণে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক শাহীনুল ইসলামকে ছুটিতে পাঠায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৮ সেপ্টেম্বর সরকার তাঁর নিয়োগ বাতিল করে। কিন্তু এর বাইরে তাঁর আর্থিক অনিয়ম, কর ফাঁকি ও টাকা পাচারের বিস্তৃত চিত্র সামনে আসায় বিষয়টি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
বাংলাদেশের আর্থিক খাতের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা হয়েও তিনি যেভাবে আইনের তোয়াক্কা না করে কোটি কোটি টাকা লেনদেন এবং বিদেশে পাচার করেছেন, তা দেশের আর্থিক শৃঙ্খলার জন্য বড় ধরনের হুমকি বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শাহীনুল একা নন। গত এক বছরে অনেক প্রভাবশালী অবৈধ অর্থের ঠিকানা করেছেন কানাডা। মানি লন্ডারিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই ধরনের ব্যক্তিরা এ সময়ে কানাডায় অর্থ পাচার করেছেন। গত বছরের ৫ আগস্টের পর যারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, তাদের অনেকেই কানাডায় অবস্থান করছেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তারা তাদের বাংলাদেশের সম্পদ বিক্রি করে কানাডায় নিয়ে গেছেন। আর এই সময়ে অনেকে বিপুল বিত্তবান হয়ে বিপুল অর্থ পাচার করেছেন কানাডায় তাদের নিকটজনের কাছে।