Image description

রাসায়নিক সারের সংকট, সরবরাহ ঘাটতি ও মূল্যবৃদ্ধি কৃষি খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, আমদানিতে নানা জটিলতা এবং সরকারের বিপুল ভর্তুকির কারণে এ খাতে টেকসই সমাধান চায় কৃষি বিভাগ। এই প্রেক্ষাপটে সরকার বিকল্প হিসেবে জৈব সার ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। কৃষি বিভাগ বলছে, রাসায়নিক সারে নির্ভরতা কমিয়ে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব কৃষি গড়তে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।

 

 

রাসায়নিক সারে বিপুল আমদানিনির্ভরতা : বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় ৬৮ লাখ টন রাসায়নিক সারের চাহিদা রয়েছে। এর ৮০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। শুধু ২০২০-২১ অর্থবছরেই সারের জন্য সরকারকে সাত হাজার ৭১৭ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছিল। বর্তমানে এই ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।

 
আন্তর্জাতিক বাজারে দামের ওঠানামা এবং বৈশ্বিক সরবরাহ সমস্যার কারণে প্রতিবছরই সারের সংকট দেখা দেয়।

 

কেন দরকার জৈব সার : রাসায়নিক সারের সংকট মোকাবেলা ছাড়াও জমির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন কৃষিবিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, জৈব সার হলো এমন এক ধরনের সার যা প্রাকৃতিক উৎস যেমন—গোবর, পোলট্রি বর্জ্য, ফসলের অবশিষ্টাংশ ইত্যাদি থেকে তৈরি হয়। এটি রাসায়নিক সারের তুলনায় ধীরে কাজ করে, তবে মাটির উর্বরতা ও গুণগত মান রক্ষা করতে সহায়ক।

 

 

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাসায়নিক সার ব্যবহারে শুরুতে ফলন বাড়লেও দীর্ঘ মেয়াদে মাটি ও পরিবেশের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মাটি এসিডিক হয়, ফলনে পুষ্টি কমে যায় এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও এর প্রভাব পড়ে। ফলে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।’

মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের  আবাদি জমিতে নানা পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে গবেষণায় ৩২ লাখ হেক্টর জমিতে ফসফরাস, ২৭ লাখ হেক্টর জমিতে পটাসিয়াম, ৩৩ লাখ হেক্টর জমিতে প্রয়োজনের তুলনায় গন্ধক অনেক কম পাওয়া গেছে।

 
আর দেখা গেছে ৩৬ লাখ হেক্টর জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১.৭ শতাংশের নিচে, যা খুব উদ্বেগজনক। আবার বেশির ভাগ জমিতে নাইট্রোজেনের ঘাটতিও রয়েছে। এ অবস্থায় জৈব সার ব্যবহারের বিকল্প নেই।

 

উৎপাদন বাড়াতে সহজ হচ্ছে অনুমোদনপ্রক্রিয়া : বর্তমানে দেশে জৈব সারের উৎপাদন প্রায় ৩২ লাখ টন। এর মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মাত্র দুই লাখ টন উৎপাদন করে। অথচ কৃষি বিভাগের লক্ষ্য আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই উৎপাদন ৮০ লাখ টনে উন্নীত করা। এতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার এক-পঞ্চমাংশ কমানো সম্ভব হবে এবং সরকারের কয়েক হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। তবে জৈব সার ব্যবহারে অন্যতম বড় বাধা হচ্ছে এর অনুমোদনপ্রক্রিয়ার জটিলতা। 

জৈব সার উৎপাদক রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, জৈব সার অনুমোদনের জন্য প্রথমে ল্যাব টেস্ট, পরে আবার ফিল্ড ট্রায়াল করতে হয়। এরপর আবার একাধিকবার ল্যাব টেস্ট করাতে হয়। এভাবে অনুমোদন পেতে সময় লেগে যায় তিন-চার বছর। এরপর ঢাকায় গিয়ে কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের মাধ্যমে অনুমোদন নিতে হয়। এতে সময় ও অর্থ দুই-ই অপচয় হয়। এ কারণে জৈব সারের অনুমোদনে কেউ উদ্যোগী হচ্ছেন না।

বিষয়টি স্বীকার করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (সার ব্যবস্থাপনা) আমিনুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জৈব সার ব্যবহারে উৎসাহ দিতে অনুমোদনপ্রক্রিয়া সহজ করা হচ্ছে। এখন থেকে জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ে এই সার ব্যবহারের অনুমোদনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঢাকায় এসে আর ভোগান্তিতে পড়তে হবে না।’

দেশে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পোলট্রি বর্জ্য, গবাদি পশুর গোবর, উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশ, ময়লা-আবর্জনা ইত্যাদি জমা হয়। এসবের সঠিক ব্যবহারে উন্নতমানের জৈব সার উৎপাদন করা সম্ভব। আমিনুল ইসলাম আরো বলেন, পোলট্রি বর্জ্যকে নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাসিয়ামসমৃদ্ধ জৈব সারে রূপান্তর করে রাসায়নিক সারের টেকসই বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব।

কৃষিবিজ্ঞানী রবিউল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যথাযথ পদ্ধতিতে বিভিন্ন জৈব সার ব্যবহার করা গেলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। এতে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়, পরিবেশদূষণ কমে, ফসলের গুণগত মান ভালো হয় এবং কৃষকের খরচও কমে।’

জৈব সারের প্রসারে শুধু উৎপাদন ও অনুমোদনই যথেষ্ট নয়, কৃষকদের সচেতনতা ও আগ্রহও জরুরি। অনেক কৃষক এখনো রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল। তাঁরা জৈব সার ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি জানেন না। এ জন্য মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের ভূমিকা বাড়ানো, প্রশিক্ষণ দেওয়া ও কৃষকদের উৎসাহিত করা প্রয়োজন।