Image description

হাসিনা সরকারে আমলেও ঠিক একই কায়দায় ভোট হতো। ওই সময় সব নিয়ন্ত্রণ করতেন নাজমুল হাসান (পাপন)। তখনও ভোট হতো, দেখানো হতো প্রতিদ্বন্দ্বিার দৃশ্যও, কিন্তু কার্যত দু’একটি পদ ছাড়া বাকী পদগুলোতে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো না। এবারও প্রায় একই স্টাইলে ভোট হয়েছে। পাপনের আমলেও ভোটের আগে প্রার্থীদের পোস্টার ব্যানারে স্টেডিয়াম এলাকায় একটা সাজ সাজ রব তোলা হতো, এবাই এর কমতি ছিল না। আগের মতোই সাজানো চিত্রনাট্যে ভোট হয়, শুধু পাল্টায় অভিনেতা-অভিনেত্রী আর কলা-কুশলি

 

রাজধানীর একটি হোটেলে ৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয়ে গেলে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালনা পরিষদের নির্বাচন। এই নির্বাচনের আগে নানা বিতর্ক হয়। নির্বাচনে সরকারের হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিস্তারসহ নানা অভিযোগ দৃশ্যপটে আসে ভোটের আগেই। শেখ হাসিনা সরকারে আমলেও ঠিক একই কায়দায় ভোট হতো। ওই সময় সব নিয়ন্ত্রণ করতেন নাজমুল হাসান (পাপন)। তখনও ভোট হতো, দেখানো হতো প্রতিদ্বন্দ্বিার দৃশ্যও, কিন্তু কার্যত দু’একটি পদ ছাড়া বাকী পদগুলোতে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো না। এবারও প্রায় একই স্টাইলে ভোট হয়েছে। পাপনের আমলেও ভোটের আগে প্রার্থীদের পোস্টার ব্যানারে স্টেডিয়াম এলাকায় একটা সাজ সাজ রব তোলা হতো, এবাই এর কমতি ছিল না। আগের মতোই সাজানো চিত্রনাট্যে ভোট হয়, শুধু পাল্টায় অভিনেতা-অভিনেত্রী আর কলা-কুশলি। ভোটের আগেই নানা অভিযোগে নির্বাচন থেকে সওে দাঁড়ান ২১ প্রার্থী, নির্বাচনের আগেই পরিচালক পদ নিশ্চিত হয় যায় ৯ জনের, বিসিবি সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।

এই নির্বাচন ঘিরেই গত কিছুদিন সরগরম ছিল দেশের ক্রিকেট অঙ্গন। তবে সেখানে ছিল না উৎসবের আবহ। বরং নানা অভিযোগ ও বিতর্কে রঙ হারিয়ে নির্বাচন হয়ে উঠেছে চরম প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন মোট ২১ জন প্রার্থী। এমনকি নির্বাচনের আগে রাত ২টার পর নাম প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন ক্লাব ক্যাটাগরির প্রার্থীদের একজন মোহাম্মদ ফায়জুর রহমান ভূঞা। নির্বাচনের আগেই বিসিবি পরিচালক পদ নিশ্চিত হয়ে গেছে ৯ জনের। সবচেয়ে বেশি ১২ পরিচালক আসেন যে কোটা থেকে, সেখানেও আদতে আকর্ষণের কিছু অবশিষ্ট ছিল না।
কেবল ৩ নম্বর ক্যাটাগরিতে (সাবেক ক্রিকেটার, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন সংস্থা) সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ (পাইলট) ও সাবেক ক্রিকেটার দেবব্রত পালের লড়াই ঘিরেই রোমাঞ্চ যা একটু ছিল। এছাড়া ১ নম্বর ক্যাটাগরিতে (জেলা-বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা) রংপুর বিভাগে কিছুটা দৃষ্টি ছিল, যেখানে একটি পদের লড়াইয়ে ছিলেন তিনজন। নির্বাচনে সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলতে এই দুটিই!

নাজমুল হাসান (পাপন) টানা তিনবার বিসিবি সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এবার আমিনুল ইসলামও (বুলবুল) একইভাবে কোনো বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বীতায় ফের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। চার মাস আগে নাটকীয় পালাবদলের পথ ধরে ফারুক আহমেদের জায়গায় সভাপতি হন আমিনুল। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘একটি কুইক টি-টোয়েন্টি ইনিংস’ খেলে বাংলাদেশের ক্রিকেটে ছাপ রাখতে চান তিনি এবং দীর্ঘমেয়াদে থাকার ইচ্ছে তার নেই। সেই আমিনুলই কিছুদিন আগে সংবাদমাধ্যমে বলেন, ক্রীড়া উপদেষ্টা চাইলে তিনি আবার সভাপতি হয়ে কাজ চালিয়ে যেতে চান। শেষ পর্যন্ত তার সেই চাওয়া পূরণও হয়েছে। সময়ের প্রবাহে অবশ্য অভিযোগ উঠেছে, ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া আড়াল থেকে কলকাঠি নেড়ে সবকিছু করেছেন। আমিনুল যে ক্রীড়া উপদেষ্টার পছন্দের, এটা নানা সময়ে দুজনের বক্তব্য থেকেই উঠে এসেছে।

বিসিবি সভাপতি পদের লড়াইয়ে আমিনুলের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তামিম ইকবাল। যদিও আড়ালে নানা সমীকরণ চলছিল, উপদেষ্টার বারংবার উদ্যোগে দুই পক্ষের সমঝোতার চেষ্টা চলছিল। উপদেষ্টা নিজেও সেটি সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরেছেন। বড় প্রশ্ন উঠে গেছে সেখানেই। ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবক হিসেবে ক্রীড়া উপদেষ্টার কাজ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা বা ক্ষেত্র তৈরি করা। সেখানে সমঝোতার চেষ্টা কেন করতে হবে! অভিযোগ উঠেছে, আমিনুলকে সভাপতি করতেই সমঝোতার চেষ্টা করে গেছেন ক্রীড়া উপদেষ্টা।
উপদষ্টার সমঝোতার চেষ্টায় কাজ হয়নি। তামিম ইকবাল ও নাম প্রত্যাহার করে নেওয়া অন্যদের দাবি, নির্বাচনের কোনো সুষ্ঠু পরিবেশই তারা পাননি। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে গত বুধবার সরে দাঁড়ান তামিমসহ ১৬ জন প্রার্থী। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতায় বড় ধাক্কা লাগে তখনই। নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর কিছুদিন পরই একটি সংবাদ সম্মেলনে তামিম বলেছিলেন, সরকারের একটি অংশ নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার পরও সাবেক এই অধিনায়ক তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। “আপনারা জিততেও পারেন, হারতেও পারেন, তবে আজকে ক্রিকেট শতভাগ হেরে গিয়েছে। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই। আপনারা বড় গলায় যে বলেন বাংলাদেশে ফিক্সিং বন্ধ করা লাগবে। আগে নির্বাচনের ফিক্সিং বন্ধ করুন, পরে ক্রিকেটের ফিক্সিং বন্ধ করার চিন্তাটা করবেন।”
নাম প্রত্যাহার করে নেওয়া আরেক প্রার্থী ইসরাফিল খসরু বলেন, “বিসিবি নির্বাচনে নগ্ন হস্তক্ষেপ চলছে। নির্বাচনের কোনো পরিবেশ এখানে নেই। স্বেচ্ছাচারিতা করা হচ্ছে। নতুন বাংলাদেশে এই ধরনের কোনো নির্বাচন আমরা চাই না। সরকারের একটি গোষ্ঠী এখানে হস্তক্ষেপ করছে। আপাতত এটুকুই বলতে পারি। শিগগিরই সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত বলব আমরা।”

মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময়সীমা শেষ হয়ে গেলেও নির্বাচন বর্জনের পালা শেষ হয়নি। শুক্রবার মধ্যরাতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান লুৎফর রহমান বাদল। কারণ খোলাসা না করে তিনি বলেন, “অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি কখনো অনুকূলে থাকলে সবাইকে জানাব, কেন এবং কী কারণে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম।” গত শনিবার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে রাজশাহী বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার কাউন্সিলর হাসিবুল আলম বলেন, “আগের নির্বাচনের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি এখন চোখে পড়ছে। সুষ্ঠু ভোট হচ্ছে না, বরং এটা প্রহসনের নির্বাচন হয়ে যাচ্ছে।”
বিসিবি সভাপতি আমিনুল ও বিসিবি পরিচালক নাজমূল আবেদীনের সঙ্গে পরিচালক পদের লড়াইয়ে ছিলেন যিনি, সেই এসএম আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ রেদুয়ান নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে যান ভোটের আগের দিন দুপুরে। জামালপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার এই কাউন্সিলর বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের রাতের ভোটকেও হার মানিয়েছে বিসিবির এবারের নির্বাচন।
নাজমুল হাসানের (পাপন) বোর্ডে বছরের পর বছর ধরে এমনভাবেই সবকিছু গড়ে নেওয়া হয়েছিল যে, নির্বাচন ছিল স্রেফ নিয়মরক্ষার আনুষ্ঠানিকতা। গত বছর দেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর দুজন সভাপতির দায়িত্ব পেরিয়ে নির্বাচন হয়েঠে ঠিকই সেই নির্বাচনও হয়েছে আগেই আঁকা ছবির মোড়ক উন্মোচন।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালনা পরিষদের নির্বাচন হয়েছে সোমবার। সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। সহ-সভাপতি মো. শাখাওয়াত হোসেন এবং ফারুক আহমেদ। নতুন মেয়াদে তারা আগামী ৪ বছর বিসিবির পরিচালনা পর্ষদের নেতৃত্ব দেবেন। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হক বলছেন, এই নির্বাচন নিয়ে যে প্রত্যাশা ছিল তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আমিনুল হক আজ মঙ্গলবার রাজধানীর পল্টনে ভলিবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন। বলেন, ‘ক্রীড়া উপদেষ্টা ও তাদের সহচরদের যে স্বেচ্ছাচারিতা তা বিসিবি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এই ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা যারা ক্রিকেটপ্রেমী রয়েছে তাদের এবং সবাইকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ বিষয়টি আমাকে অত্যন্ত পীড়া দিয়েছে।’

এদিকে, বিসিবি পরিচালনা পর্ষদে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) মনোনীত দুই পরিচালকের একজন হয়েছিলেন ব্যবসায়ী ইসফাক আহসান। কিন্তু গতকাল বিসিবির নির্বাচনের পর রাতেই সিদ্ধান্ত বদলায় এনএসসি। আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতার কারণে ইসফাকের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, তাঁর জায়গায় করপোরেট ব্যক্তিত্ব ও নারী ক্রীড়া সংগঠক রুবাবা দৌলাকে আজ বিসিবির পরিচালকের পদে মনোনয়ন দিয়েছে এনএসসি। রুবাবা দৌলা বর্তমানে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ওরাকল বাংলাদেশ নেপাল-ভুটানের কান্ট্রি ডিরেক্টরের দায়িত্বে আছেন। এর আগে তিনি টেলিকম সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন ও এয়ারটেলের শীর্ষ পর্যায়ে কাজ করেছেন। রুবাবা দৌলা সম্পৃক্ত ছিলেন খেলাধুলার সঙ্গেও। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের সভাপতির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাংলাদেশ স্পেশাল অলিম্পিকসের বোর্ড সদস্যও ছিলেন রুবাবা দৌলা।

শীর্ষনিউজ