Image description

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ দ্রুত নির্বাচন কমিশনের অধীনে নেওয়ার সুপারিশ এসেছে ইসির সঙ্গে সাবেক কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে।

‘দল নিরপেক্ষ’ ভূমিকার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনে প্রশাসনে প্রয়োজনীয় রদবদল আনতে সরকারকে প্রস্তাব দেওয়ারও অনুরোধ করেছেন ইসির সাবেক কর্মকর্তারা।

মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) নির্বাচন ভবনে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ হিসেবে সাবেক কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা শোনে এএমএম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। চার নির্বাচন কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, “সাবেক কর্মীদের পরামর্শ চিন্তা খোরাক যোগাবে। ব্যাংক থেকে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নেওয়ার কথা চিন্তা করছি, কারণ সরকারের বাইরে বেশিরভাগ নেওয়া যায় কিনা।

“আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে ব্যাংক অফিসিয়ালদের বিষয়ে। কনসার্ন অ্যাড্রেস করব। তালিকা নিয়ে আমরা যা করার করব।”

ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের মধ্যে যাতে দলীয় লোক না থাকে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার প্রতিশ্রুতিও তিনি দিয়েছেন।

সিইসি বলেন, “অন্তর্যামী হল একমাত্র আল্লাহ। অন্তরের মধ্যে দলীয় মনোবৃত্তি আছে কিনা জানা সম্ভব না। কিন্তু দলদাসের মত কাজ করতে পারবেন না এটা নিশ্চিত করব। মনের মধ্যে রাজনৈতিক মনোবিলাস থাকলেও কাজে যেন প্রতিফলন না হয় তা নিশ্চিত করা হবে।”

সতর্কবাণী উচ্চারণ করে তিনি বলেন, “আমাদের বার্তা ক্লিয়ার। নির্বাচন করা শুধু ইসির দায়িত্ব না। ন্যাশনাল ইলেকশন তো ন্যাশনাল ডিউটি। সুষ্ঠু ভোটের জন্য যত কার্যক্রম নেওয়া দরকার নেব, যাতে কেউ দলীয় আচরণ করতে না পারে।”

যেসব পরামর্শ এল
ইসির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. জকরিয়া বলেন, “ইসির কর্মকর্তা রয়েছে আড়াই হাজার, কিন্তু নির্বাচনে দরকার প্রায় ১০ লাখ লোকবল। ফলে ইসির একার পক্ষে এ কর্মযজ্ঞ সম্ভব নয়। সব ধরনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ভোটের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। তাদের নিয়োগের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।”

তিনি বলেন, “লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা দেখতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান রয়েছে একেবারে দলীয়। ইসলামী ব্যাংক বা এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে (অতীতে) লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। এবারও এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।”

“গত তিনটি নির্বাচনে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের অ্যাভয়েড করতে হবে যাতে অহেতুক প্রশ্নবিদ্ধ না হয়।”

বৈধ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে, সীমান্ত পথে আসা অস্ত্র, নকল টাকা ছড়ানো বন্ধ করা, সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনা, কালোটাকা নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে ইসিকে তৎপর হওয়ার পরামর্শ দেন এ বিশেষজ্ঞ।

তিনি বলেন, “সরকার ও ইসির নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। মাঠ প্রশাসন, বেসামরিক প্রশাসন দলীয় প্রভাব মুক্ত করতে হবে, সরকারকে এ ধরনের উদ্যোগ নিতে বলতে হবে ইসিকে।”

তিনি বলেন, “২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সচিব থেকে ওসি পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়, যাতে মানুষের মধ্যে নিরপেক্ষতার ধারণা জন্মে। এবারও কিছু কর্মকর্তাকে যেন এমন বদলি করা হয়।”

১৯৭৩ সাল থেকে তফসিল ঘোষণার পর প্রয়োজনে সময় সূচিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে জকরিয়া বলেন, “২০১৪ সালে সময়সূচিতে ছাড় দেওয়া হয়নি তখনকার ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ কমিশনের কারণে। আগামী নির্বাচনে এ বিষয়ে নজর রাখতে হবে।”

‘মব ভায়োলেন্স’ ও ‘এআই এর অপব্যবহারের’ মত নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইসির তৎপরতা, কমসংখ্যক ভোটার নিয়ে ভোটকেন্দ্র করা, জনসচেতনতার জন্য প্রচার, নির্বাচন কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুদিনের মধ্যে ইসির নিয়ন্ত্রণে আনা, ভোট পাহারা কমিটি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারায় স্থানীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে পাহারা কমিটি করা যায় কিনা, সে চিন্তা করার পরামর্শ দেন এ সাবেক কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা এখন অনেক, তাদেরকে যদি অল্প সময়ের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিয়ে নিয়োজিত করা হয়, তা ফলপ্রসূ হতে পারে।”

ইসির সাবেক যুগ্ম সচিব খন্দকার মিজানুর রহমান বলেন, “৩৩ বছরের চাকরি জীবনে ১১টি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। ভিন্ন পরিস্থিতির কারণে এবার নির্বাচন ‘সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের’ হবে।”

তিনি বলেন, “বর্তমান ইসি আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা করছেন। পোস্টাল ব্যালট প্রবাসীদের জন্য কার্যকরী করার জন্য প্রথমবার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সফল হবেন আশা করি। এটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে।”

বাস্তবতা বিবেচনায় এক জেলায় একাধিক রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ এবং তফসিলের সময় বাড়ানোর সুপারিশ করেন মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, “৪৫ দিনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে অতীতে। পোস্টাল ব্যালটের সুবিধার্থে তফসিলের সময় বাড়ানো হলে ভালো হবে। যাতে ব্যালট পেপার ছাপানো ও পৌঁছানোর সুবিধার্থে বেশি সময় নিয়ে তফসিল দেওয়া যেতে পারে।”

নির্বাচন কর্মকর্তার পাশাপাশি ছবিসহ ভোটার তালিকা এজেন্ট, অবজারভারসহ সবাইকে দেওয়ার পরামর্শ দেন সাবেক এই কর্মকর্তা।

তিনি নির্বাচনী তদন্ত কমিটির তৎপরতা বাড়ানো, আচরণবিধি যথাযথ প্রতিপালনে বাধ্য করা, নির্বাচন কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া, বিধি ভঙ্গ করলে ইসির শক্ত অবস্থান নেওয়া, দক্ষ কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের অনুরোধ করেন সাবেক এ কর্মকর্তা।

ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেন সাবেক ইসি কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জমান তালুকদার। তার মতে, “সেটা সম্ভব হলে ইসির সরাসরি নিয়ন্ত্রণে সব কাজ সুচারুভাবে করা সম্ভব হবে।”

১৯৮৬ সালে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, “নির্বাচন কমিশন, রিটার্নিং অফিসার ও প্রিজাইডিং অফিসার ভোটের প্রধান দায়িত্বে থাকে; আর বেসামরিক প্রশাসন সহায়তা করে। ইসির দক্ষ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিলে ভালোভাবে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব।”

ইসির সাবেক উপ সচিব মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, “২০০৭ সালে পোস্টাল ব্যালটের জন্য কারাগারের ৮৭ হাজার ভোটারের তথ্য সংগ্রহের পরও বিষয়টি এগোয়নি।”

পোস্টাল ব্যালটের ভোট নিয়ে হারজিতের পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, “পোস্টাল ব্যালটের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আগামী নির্বাচনে এ নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।”

তিনি বলেন, “ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের সহায়তা না করলে বেশ জটিলতায় পড়তে হবে। ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন করতে হয়েছে। ২০০৬ এ ২২ জানুয়ারির বাতিল নির্বাচনে এমন পরিস্থিতি হয়েছিল তারা কাজ করবে না।”

সাবেক এ কর্মকর্তা বলেন, “ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০০৮ সালে ইসলামী ব্যাংক, সোশাল ইসলামী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক কর্মকর্তাদের বাদ দেওয়া হয়েছিল। এবারও কর্মকর্তা নিয়োগে সতর্ক থাকতে হবে।”

অঙ্গীভূত আনসারদের ক্ষেত্রে ‘দলীয় নিয়োগের’ অভিযোগ থাকায় এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন মিহির সারওয়ার মোর্শেদ।

ভোটের দিন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুবিধার্থে তিনিও নির্বাচন কর্মকর্তাদের ‘ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার’ দেওয়ার দাবি জানান।

ভোট গণনার ব্যবস্থাপনার স্বার্থে গণমাধ্যমকে কেন্দ্রের বাইরে রাখার পরামর্শ দেন সাবেক এ কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “ভোট শেষে গণণার সময় মিডিয়াকর্মীরা কেন্দ্রের ৪০০ গজের ভেতরে যেন কোনোভাবে ঢুকতে না পারে। কাজ দৃষ্টিনন্দন করতে গিয়ে অবস্থা কাহিল হয়। ভোট গণণার সময় অসুবিধা হয়।”

“ভোটার, এজেন্ট, কারো কাছে যেন মোবাইল না থাকে। প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসাররা কেউ গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতে পারবে না।”

সাবেক আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. শাহ আলম বলেন, “আগামী নির্বাচন ইসির জন্য বেশ চ্যালেঞ্জের। আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। ইসিকে প্রথমে দলকে কন্ট্রোলে নিয়ে আসতে হবে। তফসিল ঘোষণার এক মাস আগে থেকে আচরণবিধি প্রয়োগ করতে হবে।”

মীর মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচন করেছি। মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন নিয়ম ভঙ্গ করেনি। কারণ, আমাদের কোনো প্রভু থাকে না। এবারও আমাদের প্রভু থাকবে না, ইসির ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সুষ্ঠু সুন্দর নির্বাচন হবে।”

মিছবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “ইসি ভালো কাজ করছে। জনগণ এখনও ইসির ওপর আস্থা আনতে পারছে না, কারণ গত তিনটা নির্বাচনের কারণে এমন হয়েছে। এজন্য বর্তমান কমিশনকে আস্থা ফেরাতে কাজ করতে হবে।”

ভোটের সময় রাবার সিলের পরিবর্তে অটো সিল এবং মার্কিং সিল ব্যবহারের পরামর্শ দেন মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী।

নির্বাচনী আইন-বিধি প্রতিপালন এবং নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু রাখতে এখন থেকেই উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ করেন মাহফুজা আক্তার।

তিনি বলেন, “আইন করে ও নির্দেশনা জারি করে দিয়েই ক্ষান্ত হলে হবে না। ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদেরও যথেষ্ট সুযোগ দিতে হবে।”

‘লোম বাছতে কম্বল উজাড় অবস্থা’
“গেল তিন নির্বাচনে ‘বিতর্কিত’ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের বাদ দেওয়ার দাবি নিয়ে ‘লোম বাছতে কম্বল উজাড়’ অবস্থায় পড়ার কথা,” বলেন সিইসি।

তিনি বলেন, “গত তিনটা নির্বাচনে যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের নিয়ে সবাই তো সন্দেহ পোষণ করে। তবে ভালো-খারাপ তো সবখানেই আছে। কিন্তু অনেকে বলছেন, গত তিন নির্বাচনে যারা কাজ করেছেন, তারা যেন ধারে-কাছে না আসতে পারে।”

“এখন ১০ লাখ লোকের (ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা) মধ্যে বাদ দিতে গেলে, কম্বলই উজাড়। লোম বাছতে গিয়ে কম্বল উজাড়-আমার অবস্থা হয়েছে সেরকম।”

ভোটের দায়িত্বে যারা থাকবেন, তাদের জাতীয় দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন সিইসি।

নাসির উদ্দিন বলেন, “সুতরাং তাদের (মধ্যে থেকে) কিছু নিতে হবে। তবে তাদের নজরদারির মধ্যে রাখা হবে। মানুষ তো মানুষই। বিবেক আছে তো। সে তো পরিস্থিতি বুঝবে, কখন কোথায় কাজ করছে। কাজেই অনেকেই দেখবেন সঠিক আচরণ করছেন।…ন্যাশনাল ইলেকশন ন্যাশনাল রেসপন্সিবিলিটি।”