জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়নে তাড়াহুড়ো করা ঠিক হবে না বলে মনে করছেন রাজনীতিবিদরা। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পর এবার এ নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, রাষ্ট্রচিন্তক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত বলে মত দিয়েছেন তারা। তাদের ভাষ্য, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে দলমত নির্বিশেষে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। তাই এ ঘোষণাপত্রে সবার মতামতের প্রতিফলন থাকা উচিত। না হলে তা গ্রহণযোগ্যতা হারাতে পারে। এজন্য ঘোষণাপত্র তৈরির আগে আরও আলোচনা করা প্রয়োজন।গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরের কাছে এমন অভিমত তুলে ধরেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাই এ বিষয়ে সবার মতামত নেওয়া উচিত।এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবারের বৈঠক ছিল প্রথম বৈঠক। বৈঠকে সবাই প্রাথমিক মতামত দিয়েছেন। ঘোষণাপত্র তৈরি করতে চাইলে কোন কোন ইস্যু তাতে থাকবে সেসব বিষয়বস্তু রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া উচিত। এসব ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে। তারপর তাদের মতামত বিস্তারিতভাবে তুলে ধরবে। তখন তা বিচার-বিশ্লেষণ করে ঘোষণাপত্র তৈরি করলে তা বাস্তবসম্মত হবে। পাশাপাশি ছাত্র ও রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও আরও অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত।’
এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫-১৬ বছর ধরে আন্দোলন করেছে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা। শেষদিকে কোটাবিরোধী আন্দোলনে নিয়ে মাঠে নামে ছাত্ররা। তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি দলমত নির্বিশেষে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সম্পৃক্ত হয়। এতেই সে আন্দোলনে সফলতা আসে। গত ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে বিজয় আসে। ছাত্ররা এটাকে নিজেদের সফলতা ভেবে প্রমাণ করতে চায় এটা তাদের আন্দোলনের ফসল। তারা একেক সময় একেক ইস্যু তৈরি করছে। তবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরি করতে ছাত্র ও রাজনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকের পর এখন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। কারণ আন্দোলনের শেষের দিকে দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। তাই তাদের মতামত ছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র অসম্পূর্ণ হবে। তাদের মতামত এড়িয়ে গেলে চলবে না।’
ছয়টি রাজনৈতিক দলের জোট ‘গণতন্ত্র মঞ্চের’ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র ও রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার মানুষ যেমন শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমজীবী মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। বিশেষ করে রিকশাশ্রমিক থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকরা মারা গেছেন এ আন্দোলনে। এরাও আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিলেন। এখন সবার মতামতের ভিত্তিতে গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরি করা উচিত। তাহলে এ ঘোষণাপত্র পূর্ণাঙ্গ হবে।’জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গত বৃস্পতিবার সর্বদলীয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা পরামর্শ দিয়েছি, সরকারের এমন মূল্যবান ঘোষণাপত্রের জন্য আরও মতবিনিময় হওয়া দরকার। তবে ঘোষণাপত্রের খসড়ায় অনেক মৌলিক জিনিস বাদ পড়েছে। বাংলাদেশে ইসলামী শক্তি বড় একটি শক্তি, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে তাদের অসাধারণ ত্যাগ, বহু মানুষকে শহীদ করা হয়েছে, নিরীহ-নিরপরাধ নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে, গুম করা হয়েছে, ক্রসফায়ারে নেওয়া হয়েছে এ সত্য ইতিহাসগুলো ঘোষণাপত্রের কাঠামোয় স্থান পায়নি। ইতিহাস থেকে এমন মৌলিক বিষয়গুলো যেন বাদ না পড়ে আমরা সেগুলো সরকারের দৃষ্টিতে এনেছি। আমরা বলেছি, প্রক্রিয়াটা এমন হওয়া দরকার যাতে সব দলসহ স্টেকহোল্ডাররা মতামত দিতে পারে।’
এর আগে গত বৃহস্পতিবার অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘একতা থেকেই এ সরকার গঠিত হয়েছে। একতাই আমাদের শক্তি। আমরা কীভাবে আমাদের একতাকে সামনে এগিয়ে নেব, ৫ আগস্টকে রি-ক্রিয়েট করব সে লক্ষ্যেই আজকের বৈঠক।’সর্বদলীয় বৈঠকে অংশ নেন বিএনপির পক্ষে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধিদল, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমানের নেতৃত্বে দুই সদস্যের প্রতিনিধিদল, জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল ও প্রধান সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, খেলাফত মজলিসের সেক্রেটারি জেনারেল আহমদ আবদুল কাদেরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল ও গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ জনগণের সামনে তুলে ধরার কথা বলা হয়েছিল। এর মধ্যে ৩০ ডিসেম্বর রাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাক্সক্ষাকে সুসংহত রাখার জন্য এ ঘোষণাপত্রটি গৃহীত হবে।তিনি আরও বলেছিলেন, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ অংশগ্রহণকারী সব শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্রটি প্রস্তুত করা হবে। এতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিত, ঐক্যের ভিত্তি ও জনগণের অভিপ্রায় ব্যক্ত হবে। শফিকুল আলম বলেন, ‘আমরা আশা করছি, সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে কিছুদিনের মধ্যেই সর্বসম্মতিক্রমে এ ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হবে এবং জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে।’অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের ঘোষণা আসার পর পিছু হটেন ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি পালন করেন তারা। কর্মসূচি থেকে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ জারি করতে সরকারকে ১৫ দিনের আলটিমেটাম দেওয়া হয়। পাশাপাশি গণহত্যার দায়ে শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভা এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের দাবিও জানান তারা।
এর মধ্যে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে বৃহস্পতিবার একটি সর্বদলীয় বৈঠক হবে। সেদিনই স্পষ্ট হবে, কবে ঘোষণাপত্রটি দেওয়া হবে।এরপর সর্বদলীয় বৈঠকে গত বৃহস্পতিবার বিএনপি জুলাই ঘোষণাপত্রে তাদের দীর্ঘ আন্দোলনের মূল্যায়ন চেয়েছে। জামায়াতে ইসলামী চেয়েছে স্বাধীনতার পূর্বাপর ইতিহাসের সন্নিবেশ। শাপলা চত্বরের বিষয়টি আনার কথা বলেছে হেফাজতে ইসলাম। যেনতেন প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার পরামর্শ দিয়েছে গণসংহতি আন্দোলন। নাগরিক কমিটির নেতারা বলেছেন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে এ দলিলের বিকল্প নেই।