
গাজীপুর শিল্প এলাকা হওয়ায় এখানে অর্থনৈতিক দুঃশাসন বেশি চালিয়েছে পুলিশ ও ফ্যাসিবাদী দলটির নেতাকর্মীরা। ঘুস, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, নিয়োগবাণিজ্য, শিল্পপতিসহ বিত্তশালীদের মাদকসহ বিভিন্ন মামলায় ফাঁসিয়ে হাতানো হয়েছে শত শত কোটি টাকা। এসব অপকর্মের হোতা ছিলেন গাজীপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) হারুন অর রশিদ, যিনি পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান হন। ‘ভাতের হোটেলওয়ালা’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও তিনি রাজধানীর পার্শ্ববর্তী এই জেলাকে টাকার খনি হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
গাজীপুরে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন এসপি হারুন। বিভিন্ন ফাঁদে আটকানো, পাড়া-মহল্লায় জুয়ার আসর বসানো, আবাসিক হোটেল ও ফ্ল্যাটে যৌনবৃত্তির কমিশন এবং মাদক কারবার থেকে নিয়মিত বখরা আদায় করতেন তিনি। এরই পাশাপাশি চালাতেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে জঙ্গি নাটক সাজানো এবং মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়সহ অসংখ্য অপকর্ম।
এসপি হারুন সরাসরি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। রাষ্ট্রপতি হামিদকে তিনি নানাভাবে সম্বোধন করতেন। একই এলাকায় গ্রামের বাড়ি এবং নিজেরা পরস্পরের আত্মীয় ছিলেন বলে হারুন দাবি করতেন। তিনি মাঝেমধ্যেই বলতেন—তার আদায় করা টাকার একটি বড় অংশ রাষ্ট্রপতি হামিদকেও দিতে হতো।
শ্রীপুর পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল বেপারী আমার দেশকে বলেন, জীবনের সুখ-শান্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য, এলাকায় জনপ্রিয়তা—সবই ছিল তার জীবনে। কিন্তু এসপি হারুন গাজীপুরে যোগদানের পরই পাল্টে যায় পুরো চিত্র। তিনি বাছাই করে করে ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের আটক করতেন। শুধু তার কাছ থেকেই কয়েক কোটি টাকা আদায় করেন পুলিশের এই কুখ্যাত কর্মকর্তা। এক পর্যায়ে নগদ টাকা দিতে না পারায় জমি বিক্রি করে টাকা দিতে বাধ্য করেন হারুন। এছাড়া প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নাম করে টাকা আদায় করতেন তিনি।
তিনি জানান, শ্রীপুর উপজেলা থেকেই কয়েকশ বিএনপি নেতাকর্মী জমি বিক্রি করে হারুনের চাহিদা পূরণ করেছেন। একই কায়দায় গাজীপুরের সব উপজেলা এবং পৌর এলাকায় তালিকা বানিয়ে আটক করে টাকা আদায় করতেন হারুন। এসব অপকর্ম সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অন্তত ১৫টি টিম গড়ে তোলেন এসপি হারুন। তারা সন্ধ্যার পর দল বেঁধে মাইক্রোবাস নিয়ে বের হতেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রভাবশালীদের ধরে মাইক্রোবাসে তোলা হতো এবং ক্রসফায়ারের নামে গুলি করে হত্যার ভয় দেখিয়ে সারা রাত ঘুরিয়ে চাহিদা অনুযায়ী টাকা নেওয়ার পর ছেড়ে দিত।
তিনি আরো জানান, গাজীপুরের বিভিন্ন ব্যবসায়ী মহল হারুনের এ ধরনের চাঁদাবাজির বিষয়ে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হককে জানালে তিনি ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে কিছু বলার ক্ষমতা রাখেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।
আওয়ামী দানবদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিলেন ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা মোজাম্মেল। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৮৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তৎকালীন আপিল বিভাগের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে দিয়ে রায় করিয়ে চাকরি থেকে অন্যায়ভাবে বরখাস্তের মাধ্যমে অবিচারের নজির সৃষ্টি করেন। ভুক্তভোগীরা সবাই বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে নিয়োগ পেয়েছিলেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৮৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ দেওয়ার সময় যে পরীক্ষা নেওয়া হয়, তাতে মোজাম্মেলের মেয়ে অংশ নিয়েছিলেন; কিন্তু উত্তীর্ণ হতে পারেনি। সে সময় তার তদবিরও কাজে লাগেনি। এই ক্ষোভে ১/১১ সরকারের বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মোজাম্মেল প্রথম আঘাত করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। যে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৯৮৮ জনকে চাকরি দেওয়া হয়, ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করে ফরমায়েশি রায় নেওয়া হয়। তবে জুলাই বিপ্লবের পর ভুক্তভোগীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৫ সালের ১ জুন আদালতের মাধ্যমে চাকরি ফিরে পান ওইসব কর্মকর্তা-কর্মচারী।
এছাড়া মোজাম্মেলসহ আওয়ামী এমপি-মন্ত্রীরা এতটাই বেপরোয়া ছিলেন যে, গাজীপুরের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের ঝুট ব্যবসা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা।
আওয়ামী দুঃশাসনের আরেকটি বড় অপকর্ম হলো এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্প, যা গাজীপুরবাসীর গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে ভুল নকশায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিগত ১২ বছরেও তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। হাজার হাজার কোটি টাকা নষ্ট করে সে সময়ের সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ প্রকল্পের ঠিকাদার পরিবর্তন করেছেন। অপ্রশস্ত মহাসড়কে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দিয়ে শুধু জনগণের ভোগান্তিই বাড়িয়েছে। কখন প্রকল্প শেষ হবে—পরিষ্কার করে তা কেউ বলতে পারেন না