Image description
রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন ডিপো

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অধীন বিভিন্ন জ্বালানি বিপণন কোম্পানির ডিপো থেকে নানা কৌশলে চুরি যাচ্ছে লাখ লাখ লিটার ডিজেল। ভাউজারে (তেলের লরি) বিশেষ চেম্বার বসিয়ে কার্যাদেশের অতিরিক্ত তেল ডিপো থেকে বের করে চোরাই পথে বিক্রি করা হচ্ছে। এভাবেই বছরের পর বছর চোরাই পথে সরকারি জ্বালানি তেল বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অসাধু চক্র। আর এতে জড়িত আছেন তিন পক্ষের অসাধু ব্যক্তিরা। এরা হলো-ডিপোর কর্মকর্তা প্রেরক বা ডিপো ইনচার্জ, ডিজেল গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সরকারি কর্মকর্তা ও পরিবহণের চালক ও সহকারী। এ চক্রের একাধিক সদস্য এসব তথ্য যুগান্তরকে জানিয়েছেন।

সরকারের আমদানি করা জ্বালানি তেল দুই পর্যায়ে লুটপাট হয়। প্রথম পর্যায়ে বন্দরের মাদার ভেসেল থেকে ডিপোতে আনার সময়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ডিপো থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করার সময়। এদিকে সম্প্রতি যমুনা অয়েল কোম্পানির ফতুল্লা ডিপো থেকে ৩ লাখ ৭৫ হাজার লিটার ডিজেল উধাও হওয়ার ঘটনায় তোলপাড় চলছে। বিপুল পরিমাণ এই ডিজেলও বিশেষ ভাউজারের মাধ্যমে চুরি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তেল বিক্রি করে। বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানে তেল সরবরাহ করার ক্ষেত্রে মাঝপথে লোপাট করে দেওয়া হয় হাজার হাজার লিটার তেল।

যেভাবে ডিপো থেকে তেল বের করা হয় : সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি তেলের ভাউজারের (লরি) ধারণক্ষমতা ৯ হাজার লিটার। তেল চুরিতে ব্যবহার করার জন্য কিছু লরির ভেতরে আলাদাভাবে চেম্বার বসানো হয়েছে। চোরচক্র বিশেষ চেম্বার বসানো এসব লরিগুলো তাদের কার্যসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করে আসছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তেল সরবরাহের কার্যাদেশ থাকে লরির ধারণক্ষমতার চেয়ে কম। কিন্তু ডিপোর অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে এবং লরির চালক ও হেলপারদের সহযোগিতায় ধারণক্ষমতা বরাবর (৯০০০ লিটার) তেল বের করে আনা হয়। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কার্যাদেশ বরাবর তেল বুঝিয়ে দিয়ে অবশিষ্ট তেল কালোবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অসাধু চক্রের এক সদস্য যুগান্তরকে সরকারি তেল চুরির আদ্যোপান্ত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে তেল সরবরাহ করার সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিশেষ চেম্বার থাকা ভাউজার বা লরিগুলো ব্যবহার করা হয়। কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের তেল সরবরাহের কার্যাদেশ রয়েছে ৫ হাজার লিটার। কিন্তু তেলের ডিপো থেকে তেল লোড করার সময় কর্মকর্তা ও পরিবহণের জড়িতরা কার্যাদেশ বরাবর সাধারণ ট্যাংকে ৫ হাজার লিটার তেল ভরে নেয়। সেই সঙ্গে বিশেষভাবে তৈরি করা চেম্বারে আরও ৪ হাজার লিটার তেল ভরে নেওয়া হয়। এরপর প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ অনুযায়ী ৫ হাজার লিটার তেল সংশ্লিষ্ট ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। বুঝিয়ে দেওয়ার পর দেখা যাবে লরি পুরোপুরি খালি। কিন্তু লরির উপরের অংশে ট্যাংক সিঁড়ির সঙ্গে লাগানো। সুইচ টিপ দিলে বিশেষ চেম্বারে থাকা তেল বের হয়ে আসে। এই তেল কালোবাজারে বিক্রি করা হয়। চুরির কাজে ব্যবহৃত লরিগুলো পতেঙ্গা ৩৯ ও ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন গ্যারেজ, পাহাড়তলী এলাকার বিভিন্ন গ্যারেজ, পতেঙ্গা বাইপাস সড়ক ও বায়েজিদ লিংক রোড সড়কে পার্কিং করে রাখা হয়। রাত গভীর হলে মানুষের আনাগোনা কমে গেলে বিশেষ চেম্বার থেকে তেল চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন পেট্রোল পাম্প ও দোকানে বিক্রি করে দেওয়া হয়। বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে এই তেল কিনতে পারায় লাভ হয় বেশি। এজন্যই অসাধু ব্যবসায়ীরা চোরচক্রের কাছ থেকে তেল কিনে নেয়।

বায়েজিদ বোস্তামীর বাসিন্দা নুরুল আমিন জানান, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের তেলের ভাউজার (ট্যাংক লরি) থেকে প্রতিদিনই চোরাই তেল বিক্রি করা হয়। দীর্ঘদিন চলছে চোরাই তেলের রমরমা বাণিজ্য। চট্টগ্রাম বন্দর, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম ওয়াসাসহ সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে এই চুরি হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

তেল চুরি হচ্ছে নদীপথেও : চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে দেশি-বিদেশি জাহাজ নিয়মিত পণ্য খালাস করে। সন্ধ্যার পর চোরাই তেল পাচারের অন্যতম রুট হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এই নদীপথ। জাহাজে কর্মরত নাবিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘জরুরি মালামাল পৌঁছে দেওয়ার’ অজুহাতে মাঝিরা নৌকায় করে তেল সংগ্রহ করেন। এ তেল চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, স্থানীয় পেট্রোল পাম্প, খোলাবাজার ও ইঞ্জিনচালিত নৌযানচালকদের কাছে বিক্রি করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাইটার জাহাজেও অবৈধভাবে বাংকারিং করা হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল পরিবহণ ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল লিমিটেডের নিজস্ব জাহাজ ব্যবহার করেও চুরি চলছে বলে অভিযোগ আছে।

সূত্র জানায়, আমদানি করা জ্বালানি তেল প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থানরত মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে ডিপোগুলোয় আনা হয়। এরপর ডিপো থেকে সড়ক, রেল ও নদীপথে ট্যাংকার, ট্যাংক লরি ও রেল ওয়াগনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। এই পুরো প্রক্রিয়ায় নানা স্তরে তেল চুরি হয়। এর পেছনে রয়েছেন বিভিন্ন তেল বিপণন কোম্পানির অসাধু কর্মকর্তা, স্থানীয় সিন্ডিকেট, জাহাজের নাবিক ও অন্য সহযোগীরা। তেল পরিবহণে ব্যবহৃত ২০০ লিটারের প্রতিটি ড্রামে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ লিটার করে অতিরিক্ত তেল ভরে দেওয়া হয়, যা পরবর্তী সময়ে কালোবাজারে চলে যায়।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসানের সরকারি মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি। ফলে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বিপিসির সচিব ও এর তথ্য কর্মকর্তা শাহিনা সুলতানা শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। আমাকে খোঁজ নিয়ে জানাতে হবে। যেহেতু আমি ওই ডিপার্টমেন্টে কাজ করি না। ফলে আমার জানার কথাও নয়।’