Image description
 

টিকিটের অসম বণ্টন, ফ্লাইট কমিয়ে ও টিকিট ব্লক করে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি, গ্রুপে কিনে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর উচ্চ মূল্যে বিক্রি এবং দাম নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতির কারণে আকাশপথের যাত্রীদের বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে। 

সরকারের একটি সংস্থার প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, একই রুটের টিকিট একই এয়ারলাইন্সে যে টাকায় পাওয়া যাচ্ছে, বিদেশি অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই) ব্যবহার করে সেই এয়ারলাইন্সে টিকিট কম মূল্যে মিলছে। বিদেশি এপিআই বাংলাদেশি মধ্যস্বত্বভোগীদের ওয়েবসাইটে সংযুক্ত করে বিদেশি আইডি এবং পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। বিক্রি করা টিকিটের মূল্য পরিশোধ করতে অবৈধ প্রক্রিয়াও অনুসরণ করা হয়। এতে বাংলাদেশ থেকে বিদেশি মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে।  

 
 

সর্বশেষ গত ২ আগস্ট অনলাইনে টিকিট বুকিংয়ের প্ল্যাটফর্ম ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’ হঠাৎ তাদের ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়। দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালমান বিন রশিদ ও তাঁর বাবা রশিদ শাহ সম্রাট। 

সমকালের তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সালমান সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই ও তাঁর বাবা কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় মামলার পর পুলিশ ইন্টারপোলের সহায়তায় তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে। তবে ফ্লাইট এক্সপার্টের কাছ থেকে টিকিটের টাকা গ্রাহকরা ফেরত পাবেন কিনা– অনিশ্চিত। 

 

দেশে এর আগেও অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি-ওটিএর মাধ্যমে বড় ধরনের টিকিট জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছিল। অর্থ লোপাটকাণ্ডের আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি এর সঙ্গে জড়িত ছিল বলে পৃথক তদন্তে তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল ‘হাল ট্রিপ’। সেটিও রাতারাতি গুটিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তখনও বিপুল গ্রাহকের টাকা খোয়া গিয়েছিল। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়াই বহু বছর ধরে অনলাইনে আকাশপথের টিকিট বিক্রি করছে ৪৯ প্রতিষ্ঠান। দ্রুত কোনো আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা না হলে হাল ট্রিপ, ফ্লাইট এক্সপার্টের মতো প্রতারণার ঘটনা আরও ঘটতে পারে।  

আকাশপথের টিকিট বিক্রির জালিয়াতিতে শুধু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম নয়, আছে নানামুখী নৈরাজ্য। যথাযথ বাজার ব্যবস্থাপনা ও সেটি পর্যবেক্ষণে কার্যকর নজরদারি না থাকায় কৃত্রিম সংকট ও কারসাজির আশ্রয় নিয়ে টিকিটের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানো হচ্ছে। এয়ারলাইন্স, ট্রাভেল এজেন্সির অসাধু কর্মকর্তারা এর সঙ্গে জড়িত। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় বাণিজ্য, বস্ত্র, পাট এবং বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সমকালকে বলেন, ‘এসব নিয়ন্ত্রণে আমরা ডিজিটাল ট্রেড অ্যাক্ট করতে যাচ্ছি। অনলাইনে যে যেখান থেকে কেনাকাটা করেন অথবা কোনো ধরনের সেবা নেবেন, তার বিনিময়ে যে অর্থ পরিশোধ করা হবে তা প্রথমে একটি ‘অনলাইন ট্রানজিট পয়েন্ট’-এ জমা থাকবে। ভোক্তার কাছে পণ্য বা সেবা পৌঁছালে এবং ভোক্তা তা নিশ্চিত করলে ট্রানজিট পয়েন্ট থেকে টাকাটা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের হিসাবে যাবে। এতে অনলাইনকেন্দ্রিক জালিয়াতি বন্ধ হবে বলে আশা করছি।’ 

উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘প্রথমে আমরা চিন্তা করেছিলাম, অনলাইনকেন্দ্রিক কেনাকাটার অর্থ কোনো একটি ব্যাংক হিসাব নম্বরে থাকবে। সেখানে কেউ জালিয়াতি করতে পারে– এমন আশঙ্কায় সরে এসেছি। এখন সিদ্ধান্ত হয়েছে, অনলাইন ট্রানজিট পয়েন্ট কোনো ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে না।’ 

উপদেষ্টা আরও বলেন, ৪৯টি অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সিকে তারা শনাক্ত করেছেন। এ ছাড়া বিমান টিকিটের অস্বাভাবিক দাম বাড়ানোর সঙ্গে যে চতুর্মুখী চক্র রয়েছে তা ভাঙার কাজও শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষ যাতে ন্যায্যমূল্যে বিমানের টিকিট পায়, এটাই লক্ষ্য। তিনি জানান, এয়ারলাইন্সের টিকিট বিক্রির সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানের বিদেশি স্টাফ ও কান্ট্রি ম্যানেজারদের দুই বছরের বেশি কাজের অনুমতি দেওয়া হবে না– এমনটিও তারা ভাবছেন।  

গতকাল রাতে একাধিক এয়ারলাইন্সের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, আগামী ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে সৌদি আরবের রিয়াদে যেতে (একক যাত্রা) বাংলাদেশ বিমানে টিকিটের দাম দেখাচ্ছে ৮৮ হাজার ৪১৩ টাকা। এমিরেটস ১ লাখ দুই হাজার ২৫৯ টাকা। সৌদিয়া এয়ারলাইন্স এক লাখ ১২ হাজার ৩১ টাকা। 

একই দিনে কলকাতা থেকে রিয়াদে এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিটের দাম ২৮ হাজার ৫৭৫ টাকা, গলফ এয়ার ৫৬ হাজার ১১ টাকা, ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স ৮৩ হাজার ৫৪৩ টাকা। 
এ ছাড়া ঢাকা থেকে চীনের গুয়াংজুতে ১০ অক্টোবর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে টিকিটের দাম ৫৭ হাজার ৪৫৬ টাকা, চায়না সাউদার্নে ৬৭ হাজার ২৩০ টাকা দেখাচ্ছে। একই দিন কলকাতা থেকে এয়ার ইন্ডিয়ায় গুয়াংজুর টিকিটের মূল্য দেখায় ৪৫ হাজার ৯০০ টাকা। 

ট্যুরিজম ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ট্রাভেল এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আটাব) সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসলাম খান সমকালকে বলেন, ‘পি কে হালদারের হাত ধরে প্রথম এই খাতে বড় ধরনের জালিয়াতি হয়েছিল। যাত্রীরা বারবার টিকিট কিনে প্রতারিত হলেও জড়িতদের ধরা যাচ্ছ না। দেশে পাঁচ হাজার ৭৪৬টি ট্রাভেল এজেন্সি রয়েছে। তার মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়শেনের সদস্যপদ পেয়েছে ৯৭০ প্রতিষ্ঠান। নিয়ম অনুযায়ী যেসব এজেন্সি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলে তাদের টিকিট সরবরাহ করবে এয়ারলাইন্সগুলো। কিন্তু দেশে এয়ারলাইন্সগুলো এই নিয়ম মানছে না। টিকিটের অসম বণ্টন হচ্ছে। আবার টিকিট সরবরাহের জন্য ট্রাভেল এজেন্সির কাছে এয়ারলাইন্সগুলো বাড়তি জামানত নেয়। 

আসলাম খান বলেন, ‘অনেক দিন ধরে বলে এসেছি, অনলাইন ট্র্যাভেল এজেন্সি নিয়ে একটি নীতিমালা করা হোক। টিকিট জালিয়াতি বন্ধে সরকারের নেওয়া একাধিক বৈঠকে বলেছি, টাস্কফোর্সের পাশাপাশি একটি মনিটরিং সেল করা হোক। যারা টিকিটের চাহিদা, অন্যান্য দেশের সঙ্গে কী কারণে এত ফারাক, তা বের করে ব্যবস্থা নেবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের টিকিটের চাহিদার অধিকাংশ মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক। এদের বড় অংশ প্রবাসী কর্মী। তারা দীর্ঘ সময় ধরে বাড়তি টাকা গুনে আসছে টিকিটের জন্য।’

ফ্লাইট এক্সপার্ট মামলার তদন্তের অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে মতিঝিল থানার ওসি মেজবাহ উদ্দিন সমকালকে বলেন, তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কতজন গ্রাহকের কত টাকা ফ্লাইট এক্সপার্ট আত্মসাৎ করেছে, সেটি বের করতে তদন্ত চলছে।   

২০১৭ সালের মার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করা বিমানের টিকিট বুকিংয়ের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ফ্লাইট এক্সপার্ট। বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের টিকিট বুকিং, হোটেল রিজার্ভেশন, ট্যুর প্যাকেজের মতো নানা সেবা দিয়েছে তারা। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বাবা রশিদ শাহ সম্রাট এ খাতের পুরোনো ব্যবসায়ী। ট্রাভেল এজেন্সি ছাড়াও তাঁর মানি এক্সচেঞ্জ, রিক্রুটিং এজেন্সির ব্যবসা রয়েছে। তাঁর ছেলের এ ধরনের প্রতারণায় জড়িত থাকার বিষয়টি সামনে আসার পর এ খাতের কেউ কেউ বিস্মিত হয়েছেন। 

টিকিটের অস্বাভাবিক দাম নিয়ে তদন্তে যুক্ত সংস্থাটির প্রতিবেদনে এয়ারলাইন্সের কান্ট্রি ম্যানেজার ও সেলস স্টাফদের দুই বছরের বেশি ওয়ার্ক পারমিট (কাজের অনুমতি) না দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। বিদেশি এয়ারলাইন্সের কোন কোন এজেন্সির কাছে কত টিকিট কত টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে, তা অনুসন্ধানের জন্য তিন থেকে ছয় মাস পরপর অডিট (নিরীক্ষা) ব্যবস্থার কথাও বলা হয়। 

তাদের সুপারিশের মধ্যে আরও আছে– কোনো যাত্রী বাংলাদেশ থেকে টিকিট কিনলে তাঁর কাছে তৃতীয় দেশ থেকে টিকিট বিক্রি করা যাবে না। এয়ারলাইন্সের ডিস্ট্রিবিউশন পলিসি উন্মুক্ত রাখতে হবে। গ্রুপ সিট বুকিংয়ের ক্ষেত্রে নাম, পাসপোর্ট, ভিসা এবং ভ্রমণ নথিপত্র নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। যে রুটে চাহিদা বেশি, সেই রুটে ফ্লাইট বাড়াতে হবে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এয়ারলাইন্স জেনারেল সেলস এজেন্টের (জিএসএ) মাধ্যমে নিজেরা নিজেদের টিকিট বিক্রি করছেন। এতে দাম বাড়ানোর কারসাজিতে জড়াচ্ছেন তারা। প্রতিবেদনে বাটিক এয়ারের কথা উল্লেখ করা হয়। বাটিক এয়ার হলো ইন্দোনেশিয়ান বিমান সংস্থা, যার সদরদপ্তর জাকার্তায়। বাটিক এয়ারের জিএসএর মালিক দেশের বাইরে থাকেন। ট্রাভেল এজেন্টদের কাছে টিকিট বিক্রির জন্য তারা বিদ্যমান মূল্যের চেয়ে পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চার্জ করেন। জিএসএ কোম্পানিগুলো সরাসরি পরিচালনা করে, এমন অন্য এয়ারলাইন্সও একই ধরনের জালিয়াতিতে জড়িত। ১৫টি এয়ারলাইন্স এর সঙ্গে জড়িত ছিল বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। অবৈধ প্রক্রিয়ায় টিকিট কিনে বেশি দামে বিক্রি করছে, এমন ২৭টি ট্রাভেল এজেন্সিকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ব্যবসা করা কয়েকটি এয়ারলাইন্সের কান্ট্রি ম্যানেজার দীর্ঘ সময় থাকার কারণে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে আঁতাত রেখে টিকিটের দাম নিয়ে কারসাজি করেন। প্রতিবেদনে দুটি এয়ারলাইন্সের কান্ট্রি ম্যানেজারের নাম উল্লেখ করা হয়। তাদের একজন সাত বছর, আরেকজন পাঁচ বছর কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে বাংলাদেশে আছেন।