
দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে ১১টিতেই নেই কোনো কীটতত্ত্ববিদ। অথচ এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এডিস মশাই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়—যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কেবল ২৬টি জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে কীটতত্ত্ববিদের অনুমোদিত পদ রয়েছে, যার মধ্যে অন্তত ১২টি পদ ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শূন্য পড়ে আছে। অথচ, ডেঙ্গু এখন সারা বছরের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রাক-বর্ষা, বর্ষাকালীন ও বর্ষার পরবর্তী সময়—এই তিন দফা জরিপের বিলম্ব আরও স্পষ্ট করে তুলেছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা। এসব জরিপ মশার ঘনত্ব নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিকল্পনার জন্য অপরিহার্য।
এ বছরের প্রাক-বর্ষা জরিপের ফল প্রকাশিত হয়েছে জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে, যখন বর্ষা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। এতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হাতে পদক্ষেপ নেওয়ার সময় কমে যায়। গত বছর অর্থাভাব ও জনবল সংকটের কারণে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বর্ষা মৌসুমের জরিপই করতে পারেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কোনোভাবে জরিপ সম্পন্ন হলেও সুপারিশগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হয় না। এর পেছনে রয়েছে বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি বা জনবলের ঘাটতি।
সব মিলিয়ে এই দুর্বলতাগুলো সরকারের ডেঙ্গু মোকাবিলার প্রস্তুতির ঘাটতি প্রকাশ করছে। এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে প্রায় ২০০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৪০ হাজারের বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এ বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক জিএম সাইফুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতিবার সংকট তীব্র হয়ে প্রাণহানি ঘটলেই মশা নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা সামনে আসে। সংকট কেটে গেলে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায় সবকিছু, পরবর্তী সংকট না আসা পর্যন্ত।'
তিনি আরও বলেন, যদি সরকার সত্যিই জীবন রক্ষা করতে চায়, তবে তাদের নিয়মিতভাবে মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং বিদ্যমান ঘাটতি মোকাবিলা করতে হবে।
কীটতত্ত্ববিদের অভাব
কীটতত্ত্ববিদরা পোকামাকড়ের বৈশিষ্ট্য ও সেগুলো কীভাবে রোগ ছড়ায় তা নিয়ে গবেষণা করেন। তারা মশার সংখ্যা বাড়ছে কখন, কোথায় ছড়াচ্ছে এবং কীভাবে ছড়াচ্ছে তা শনাক্ত করতে পারেন। এছাড়া, তারা বিশেষায়িত জরিপ পদ্ধতির মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা শনাক্ত করেন।
সাইফুর রহমান বলেন, একজন কীটতত্ত্ববিদ জানেন কীভাবে মশা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করতে হয়, ঠিক যেমন একজন ডাক্তার জানেন রোগীর জন্য কোন পরীক্ষা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, কীটতত্ত্ববিদরা কীটনাশক ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন—কোন মশা কোথায় জন্মাচ্ছে, কোন রাসায়নিক প্রয়োগ করতে হবে, কী পরিমাণে এবং কোন পদ্ধতিতে ব্যবহার করতে হবে, তা তারা নির্ধারণ করেন।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১২টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে শুধু ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে একজন কীটতত্ত্ববিদ রয়েছেন। অন্যত্র প্রয়োজনে বিভিন্ন সরকারি বিভাগ বা জেলা প্রশাসন থেকে কর্মকর্তাদের ডেপুটেশনে আনা হয়।
এ বিষয়ে গত ২৫ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য দপ্তরের বিভাগীয় কীটতত্ত্ববিদ মো. মফিজুল হক শাহ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, সারাদেশে মাত্র ২৬টি সিভিল সার্জন কার্যালয়ে কীটতত্ত্ববিদের অনুমোদিত পদ আছে। এছাড়া স্বাস্থ্য দপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক কার্যালয়ে চারটি এবং সদর দপ্তরে তিনটি পদ রয়েছে। তবে ৩৩টি অনুমোদিত পদের অন্তত ১৮টি শূন্য রয়েছে।
দুর্বলতা
প্রতি বছর তিনটি পর্যায়ক্রমিক জরিপ করার নিয়ম রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে মশার ঘনত্ব ও হটস্পট শনাক্ত করা হয় এবং লার্ভা ধ্বংসে কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাধারণত শুধু দুই ঢাকার সিটি করপোরেশন ও কয়েকটি জেলায় এই জরিপ পরিচালনা করে। ফলে দেশের বেশিরভাগ অংশই নজরদারির বাইরে থাকে।
গত বছর অর্থায়ন শেষ হয়ে যাওয়ায় কোনো জরিপ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। ওই সময় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যৌথভাবে প্রাক-বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী জরিপ করে।
এ বছরও প্রাক-বর্ষা জরিপ করতে বিলম্ব হয়েছে। জরিপের ফল প্রকাশিত হয় জুনের মাঝামাঝি সময়ে, বর্ষা শুরুর কয়েকদিন পরেই। ফলে সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।
অধিকাংশ সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি বিশৃঙ্খলা ও জনবল সংকটের কারণে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে মাঠ কর্মীদের অনেকেই দায়িত্ব পালন করেন না, ফলে বহু হটস্পট সক্রিয় থেকে যায়।
অন্য সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতেও মশা নিয়ন্ত্রণে জনবল নেই
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ রহমানত উল্লাহ বলেন, করপোরেশনের প্রস্তাবিত অর্গানোগ্রামে কীটতত্ত্ববিদ ও টেকনিশিয়ানের পদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে তা এখনও স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায়।
তিনি আরও বলেন, জনবল না থাকায় বর্তমানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্রকৌশল ও অন্যান্য বিভাগ থেকে কর্মচারীদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ মুশতাক হোসেন বলেন, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষম স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইলে নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই কীটতত্ত্ববিদ ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞের গুরুত্ব বুঝতে হবে।
স্থায়ী পদ ও ক্যারিয়ার কাঠামো তৈরি করা সম্ভব না হলে অন্তত পরামর্শক হিসেবে কীটতত্ত্ববিদদের যুক্ত করার আহ্বান জানান তিনি।
এ বিষয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় সরকার বিভাগে (শহর উন্নয়ন) যুগ্ম সচিব আবুল খায়ের মোহাম্মদ হাফিজুল্লাহ খান বলেন, সরকার ইতিমধ্যেই একটি বিশ্বব্যাংক অর্থায়িত জনস্বাস্থ্য প্রকল্প গ্রহণ করেছে এবং এর মূল উপাদানগুলোর মধ্যে একটি হলো ভেক্টর (পরজীবী) ব্যবস্থাপনা।
তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু বিস্তার রোধ করার জন্য, 'শহর জনস্বাস্থ্য প্রতিরোধমূলক সেবা উন্নয়ন প্রকল্প'-এর অধীনে কীটতত্ত্ববিদসহ বিশেষজ্ঞদের পদ সৃষ্ট করা হয়েছে।
তবে প্রকল্পের আওতায় মানবসম্পদ নিয়োগে যথেষ্ট সময় লাগবে।