Image description
পুঁজিবাজার

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশ কিছু কোম্পানি পরিকল্পিতভাবে তথ্য গোপন করে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে। পরে সেই বাড়তি দরে নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে অবৈধ সুবিধা নিচ্ছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নিয়মিতভাবে বড় লোকসানের শিকার হচ্ছেন। এর জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেডের শেয়ারদর গত ২৯ জুলাইয়ের পর থেকে ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। ওইদিন ১৫২ টাকা ১০ পয়সায় লেনদেন হওয়া শেয়ারটি গত ৪ সেপ্টেম্বর লেনদেন শেষে ২৯৯ টাকা ৮০ পয়সায় দাঁড়ায়। অর্থাৎ মাত্র এক মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ১৪৭ টাকা ৭০ পয়সা বা ৯৭ শতাংশ। আর এই শেয়ারদর বাড়ার পেছনে কোম্পানিটির কৌশলই কাজে লেগেছে।

সোনালী পেপারের কাছে অস্বাভাবিক শেয়ারদর বাড়ার কারণ জানতে চেয়ে চিঠি দেয় দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। জবাবে কোম্পানিটি জানায়, শেয়ারদর বাড়ার পেছনে কোনো কারণ তাদের জানা নেই। কিন্তু টানা এক মাস কোম্পানিটির শেয়ারদর বাড়ার পর তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা তৃতীয় উৎপাদন ইউনিট চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হবে। এই যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের পর নতুন ইউনিটে উৎপাদন চালু হলে কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধি পাবে।

ঠিক একইভাবে তালিকাভুক্ত আরেকটি কোম্পানি কে অ্যান্ড কিউ (বাংলাদেশ) লিমিটেডও কৌশল অবলম্বন করেছে। মাত্র দুই মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে এই কোম্পানিটির শেয়ারদর ৯৩ শতাংশ বা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত ৮ জুলাই ১৯৮ টাকা ৬০ পয়সা লেনদেন হওয়া শেয়ারটি ১ সেপ্টেম্বর ৩৮২ টাকা ৭০ পয়সায় উঠেছে। এই সময়ের মধ্যে অন্তত দুবার ডিএসইকে কোম্পানিটি জানিয়েছে, অস্বাভাবিক এই দরবৃদ্ধির কারণ তাদের জানা নেই। অথচ দুই মাস শেষ না হতেই কোম্পানিটি নতুন করে জানায়, তারা খুচরা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সরবরাহ করবে। এজন্য একটি নতুন ইউনিট চালু করা হয়েছে। এতে কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধি পাবে।

শুধু কে অ্যান্ড কিউ (বাংলাদেশ) কিংবা সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস নয়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এমন অনেক কোম্পানি রয়েছে, যারা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এবং স্টক এক্সচেঞ্জের চোখে ধুলা দিয়ে নিয়মিত প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে

যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় তথ্য গোপনের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে নেয় কোম্পানি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা শেয়ার বিক্রি করার আগ মুহূর্তে এমনটা করে থাকেন। এতে অল্প মালিকানা বিক্রি করেই বড় অঙ্কের টাকা কোম্পানি থেকে সরিয়ে নিতে পারেন তারা।

গোপন তথ্যে বাড়ে আরও যেসব কোম্পানির শেয়ারদর: তথ্য অনুযায়ী, গত ২৯ জুলাই পরবর্তী মাত্র ১৭ কার্যদিবসে মাগুরা কমপ্লেক্স পিএলসির শেয়ারদর বেড়েছে ২৬ টাকা ৮০ পয়সা বা প্রায় ৩১ শতাংশ। ২৯ জুলাই ৮৭ টাকা ২০ পয়সা লেনদেন হওয়া শেয়ারটি ২৪ আগস্ট ১১৪ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। এই দরবৃদ্ধির বিষয়ে ডিএসই থেকে চিঠি দেওয়া হলে কোম্পানিটি জানায়, অস্বাভাবিক এই দরবৃদ্ধির কারণ তাদের জানা নেই। অথচ মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কোম্পানিটি পুনরায় জানায়, তারা তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে নতুন মেশিনারিজ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই মেশিনারিজ প্রতিস্থাপনের পর কোম্পানির আয় ও মুনাফা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে।

একই গ্রুপের আরেক কোম্পানি মনোস্পুল বাংলাদেশ পিএলসির শেয়ারদরও গত ২৯ জুলাইয়ের পর থেকে ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। ওইদিন ৯৯ টাকা ৪০ পয়সায় লেনদেন হওয়া শেয়ারটি ২৪ আগস্ট ১২৪ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। অর্থাৎ আলোচিত ১৭ কার্যদিবসের ব্যবধানে শেয়ারটির দর ২৪ টাকা ৬০ পয়সা বা প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। এই কোম্পানিটিও ডিএসইর চিঠির জবাবে জানিয়েছিল, অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির কারণ তাদের জানা নেই। একইভাবে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কোম্পানিটি পুনরায় জানায়, তারাও তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে নতুন মেশিনারিজ কিনবে। এই মেশিনারিজ প্রতিস্থাপনের পর কোম্পানির আয় ও মুনাফা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে।

এদিকে, মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের শেয়ারদরও অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে দেখা গেছে। মাত্র ১৩ কার্যদিবসের ব্যবধানে কোম্পানির শেয়ারদর ৮ টাকা ৭০ পয়সা বা ৩২ শতাংশের বেশি বেড়েছে। গত ২৪ আগস্টের ২৭ টাকার শেয়ারটি ১০ সেপ্টেম্বর লেনদেন শেষে ৩৫ টাকা ৭০ পয়সায় উঠে যায়। এই দরবৃদ্ধির কারণ নিয়ে ৭ সেপ্টেম্বর ডিএসই থেকে চিঠি দেওয়া হলে কোম্পানিটি একইভাবে জানিয়েছে, অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির কারণ তাদের জানা নেই। অথচ বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) সূত্রে জানা গেছে, মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে তারা তাদের চাহিদার অর্ধেক (৫০ শতাংশ) ব্যাগ ক্রয় করবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানটি এই বিপুল পরিমাণ ব্যাগ ক্রয় করলে মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজের মুনাফায় বড় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি চিঠিও গত ১ সেপ্টেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে ইস্যু হয়েছে। তবে মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজ বলছে, তারা এ বিষয়ে কিছুই জানে না।

এ বিষয়ে মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজের কোম্পানি সচিব মো. ওমর ফারুক ১৬ সেপ্টেম্বর বলেন, আমাদের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই। আমরা কোনো চিঠি পাইনি। চিঠি পেলে নিয়ম অনুযায়ী শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থে স্টক এক্সচেঞ্জকে জানানো হবে।

যেভাবে করা হয় কারসাজি: বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, কিছু কোম্পানি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই কাজগুলো করছে। কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা এক শ্রেণির বিনিয়োগকারীদের কাছে অনেক আগেই জানিয়ে দেন তারা। ওই চক্রটি প্রথমে নিজেরা অল্প দামে শেয়ার কিনে নেয়। পরে কিছু ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেয়। এতে শেয়ারটির দর হুহু করে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই কৃত্রিম দরবৃদ্ধি একটি পর্যায়ে গিয়ে স্থায়ী হয় না। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের একটা শ্রেণির বড় লোকসান হয়। অনেক ক্ষেত্রে কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরাও নিজেদের মালিকানার কিছু অংশ বিক্রি করে সুযোগ নিয়ে নেন।

বিশ্লেষক ও বাজার সংশ্লিষ্টরা যাদের দায়ী করছেন: কোম্পানিগুলোর কৌশল ঠিকভাবে শনাক্ত করতে না পারার পেছনে স্টক এক্সচেঞ্জ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দায়ী করছেন বিশ্লেষক ও বাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা এই দুই রেগুলেটরি বডিকে আরও বেশি সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দেন।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, কোম্পানির কাছে প্রকৃতপক্ষে তথ্য না থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে কারসাজি চক্র শেয়ারের দাম বাড়াতে পারে। তবে কোম্পানির কাছে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (পিএসআই) থাকা সত্ত্বেও যদি তারা গোপন করে, তাহলে সেটি প্রতারণা। কোম্পানির জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয়টি আমাদের দেশে তুলনামূলকভাবে কম। যখন কোম্পানিকে যথাযথ গাইডলাইনের মধ্যে এনে জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, তখন আর এই কাজগুলো হবে না।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম মনে করেন, এটি সরাসরি কোম্পানির প্রতারণা না হলেও দুর্বলতার প্রকাশ। কোম্পানিগুলোকে তাদের দায়িত্বের ব্যাপারে আরও সচেতন হতে হবে। স্টক এক্সচেঞ্জকেও আরও সক্ষমতা বাড়িয়ে তাৎক্ষণিক এই বিষয়গুলো চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নিতে হবে।

স্টক এক্সচেঞ্জ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা যা বলছে: ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, কোম্পানির ক্ষেত্রে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের একটি নির্দিষ্ট সময় আছে। তার আগে কোম্পানিগুলো সেটি প্রকাশ করতে পারে না। কেউ যদি অগ্রিম তথ্য দিয়ে ‘ইনসাইডার ট্রেড’ করে থাকে, সেটি আমরা জবাবদিহির আওতায় আনছি। আমরা এরই মধ্যে আমাদের সার্ভিলেন্স বিভাগের সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কাছেও আমরা তাদের সার্ভিলেন্স মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করার জন্য চিঠি দিয়েছি। কোনো কোম্পানি ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সার্বিক বিষয়ে বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম জানান, এ বিষয়টি তাদের সার্ভিলেন্স বিভাগ দেখাশোনা করে। এ ক্ষেত্রে ইনসাইডার ট্রেড হয়েছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (সুবিধাভোগী ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ) বিধিমালা, ২০২২ অনুযায়ী ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’ বা সুবিধাভোগী ব্যবসা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ইনসাইডার ট্রেড প্রমাণিত হলে কমিশন ১৯৬৯ অর্ডিন্যান্সের ক্ষমতাবলে সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা থেকে অপরাধের পরিমাণ অনুযায়ী কোটি কোটি টাকা জরিমানা করতে পারে। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, বাজার থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।