Image description
» চূড়ান্ত ভাষ্যে সংশোধন ও সংযোজন । » আপত্তি থাকা বিষয় দেখবে ভোটে জয়ী দল । » পটভূমিতে জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় রাজনীতি ফেরানোসহ কয়েকটি তথ্য । » স্বাধীন পুলিশ কমিশনের বিস্তারিত রয়েছে সনদে ।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে চলমান দীর্ঘ সংলাপপ্রক্রিয়ায় সমঝোতার অংশ হিসেবেই বেশ কয়েকটি বিষয়ে আপত্তি ( নোট অব ডিসেন্ট ) জানিয়েছিল কয়েকটি রাজনৈতিক দল । ওই বিষয়গুলো বাস্তবায়নের কথা জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত ভাষ্যের অঙ্গীকারনামায় ছিল না । কারও কারও দ্বিমত থাকা এই বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি কীভাবে হবে, তার উল্লেখ না থাকায় প্রশ্ন তুলেছে কয়েকটি দল । এমন অবস্থায় চূড়ান্ত ভাষ্য সংশোধন করে নোট অব ডিসেন্ট বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী দলের ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি যুক্ত করা হচ্ছে । একই সঙ্গে জুলাই জাতীয় সনদের পটভূমির বিবরণে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের ‘ লগি - বৈঠার তাণ্ডবের ’ ধারাবাহিকতায় এক-এগারো হওয়া , স্বৈরাচারী শাসকের স্থলে ' ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ' কথাগুলো প্রতিস্থাপনসহ বেশ কয়েকটি বিষয় সংযোজন হচ্ছে ।

এ ছাড়া সংশোধিত চূড়ান্ত ভাষ্যে স্বাধীন পুলিশ কমিশনের কাঠামো ও ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে । অতীতের মতো কৰ্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা ফিরে আসা ঠেকানোর লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই ধাপে সংলাপের ভিত্তিতে জুলাই সনদ তৈরি করে ঐকমত্য কমিশন । পরে তাদের সুপারিশ আমলে নিয়ে তৈরি করা সনদের চূড়ান্ত ভাষ্য গত ১১ সেপ্টেম্বর দলগুলোকে দেওয়া হয় । সে সময় বলা হয় , সনদের বিষয়ে কোনো নতুন মতামত নেওয়া হবে না । তবে সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে আয়োজিত তৃতীয় ধাপের সংলাপে দলগুলো নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে , সে প্রশ্ন তোলে । তখন অঙ্গীকারনামাসহ সনদের চূড়ান্ত ভাষ্যে কিছু সংযোজনের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন ।

জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত ভাষ্যে সংযোজন - বিয়োজনের বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত - পরামর্শের পাশাপাশি আমরাও সনদে কিছু কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি লক্ষ করেছি । সেগুলো সংশোধন করা হচ্ছে । যাতে করে সনদে স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের প্রতিফলন দেখা যায় । ’জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠক করে গত ১৬ সেপ্টেম্বর । ৫ অক্টোবর আবারও বৈঠক হবে । তার আগেই দলগুলোর কাছে সংশোধিত চূড়ান্ত ভাষ্য পাঠানো হবে । দলগুলোর মতামত নিয়ে এটি বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসবে কমিশন । এরপর ৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠক করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের ।

জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষরের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো রাজি হলে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ঘটা করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে বলে সূত্রে জানা গেছে । রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ১১ সেপ্টেম্বর পাঠানো চূড়ান্ত ভাষ্যে ঐকমত্য হওয়া ৮৪ টি বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল । কিন্তু সংশোধিত চূড়ান্ত ভাষ্যে ৮০ টি বিষয় রয়েছে ।

কমিশন সূত্রে জানা গেছে , সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়োগের প্রস্তাবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় চারটি বিষয় বাদ দেওয়া হয়েছে । এ ছাড়া সর্বশেষ ঐকমত্য হওয়া ৮০ টি প্রস্তাবে দলগুলোর নোট অব ডিসেন্টের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে । জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায় সাতটি ধারা রয়েছে । নতুনভাবে যুক্ত হওয়া আট নম্বর ধারায় বলা আছে , সনদের যেসব ক্ষেত্রে ‘ নোট অব ডিসেন্ট ’ দেওয়া হয়েছে , জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়া রাজনৈতিক দল সে মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে পারবে । পটভূমিতে যুক্ত নিকট ইতিহাস চূড়ান্ত ভাষ্যে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরির পটভূমি হিসেবে পাকিস্তানি শাসনামলসহ ঔপনিবেশিক শাসন শোষণ ও বঞ্চনার পাশাপাশি আন্দোলন - সংগ্রাম , স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে একমাত্র দল বাকশাল গঠন ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনসহ ইতিহাসের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ আছে । চূড়ান্ত ভাষ্যের পটভূমিতে ছিল ১৯৭৬ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় । নতুন ভাষ্যে ১৯৭৬ সালের কথাটি বাদ দিয়ে লেখা হয়েছে , ১৯৭৮ সালে বহুদলীয় রাজনীতির পুনঃপ্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণের ফলে ১৯৭৯ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় । পটভূমির আরেক অংশে ২০০৬ সালে কয়েকটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও তার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারি ও ‘ অস্বাভাবিক ’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার কথা ছিল ।

সংশোধন করে সেখানে লেখা হয়েছে , ‘২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে লগি - বৈঠার তাণ্ডবে দেশে কয়েকটি নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় । ২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারি এবং একটি অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় , যা ১/১১ সরকার নামে পরিচিত । ফলে নির্বাচন স্থগিত হয় । ’ আগের চূড়ান্ত ভাষ্যে জুলাই গণ- অভ্যুত্থানের বিষয়ে বলা হয়েছে , শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু ও নারীসহ প্রায় ১ হাজার নাগরিক নিহত হয় । সংশোধিত চূড়ান্ত ভাষ্যে ১ হাজারের জায়গায় ‘ সহস্রাধিক ’ বলা হয়েছে । এ ছাড়া , ‘জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের মুখে স্বৈরাচারী শাসক ও তার দোসরেরা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় ’ – এ অংশে স্বৈরাচারী শাসকের স্থলে ‘ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ' এবং পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়ার আগে ‘ অনেকেই ' শব্দটি যোগ করা হয়েছে । সংস্কার কমিশন গঠন অংশে রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে কমিশনে লিখিত মতামত দেওয়ার কথা যুক্ত করা হয়েছে । ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম অংশে দলগুলো সংলাপের ভিত্তিতে ‘ কিছু বিষয়ে ভিন্নমতসহ ' জাতীয় সনদ তৈরিতে সম্মত হয়েছে — এ কথা যুক্ত করা হয় । এ ছাড়া চূড়ান্ত ভাষ্যে ‘ ২০০৯ সাল - পরবর্তী ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ' কথা নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে ।

পুলিশ কমিশন ও অন্যান্য সংলাপে পুলিশ বাহিনীকে জনবান্ধব করতে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয় । তবে দলগুলোর কাছে পাঠানো চূড়ান্ত ভাষ্যে কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ার উল্লেখ ছিল না । সংশোধিত ভাষ্যে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে । পুলিশ কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যের বিষয়ে বলা হয় , কমিশন নিশ্চিত করবে পুলিশ যাতে আইনানুগভাবে এবং প্রভাবমুক্তভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে । পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিষ্পত্তি করবে কমিশন । ৯ সদস্যের কমিশনে কমপক্ষে ২ জন নারী রাখার কথা বলা হয়েছে । এর চেয়ারম্যান হবেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ( বয়স ৭৫ - এর বেশি নয় ) , সদস্যসচিব হবেন পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ- মহাপরিদর্শকের নিচে নয় এমন কর্মকর্তা ( বয়স অনূর্ধ্ব ৬২ বছর ) , সদস্য হিসেবে থাকবেন জাতীয় সংসদের নেতার প্রতিনিধি ( সংসদ সদস্য ) , বিরোধীদলীয় নেতার প্রতিনিধি ( সংসদ সদস্য ) , স্পিকারের প্রতিনিধি ( সংসদ সদস্য ) , ডেপুটি স্পিকারের প্রতিনিধি ( সংসদ সদস্য ) , সচিব পদমর্যাদার নিচে নন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ( জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ) , জেলা জজ পদমর্যাদার নিচে নন এমন অবসরপ্রাপ্ত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা বা সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের তালিকাভুক্ত কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আইনজীবী এবং ১০ বছরের বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন মানবাধিকারকর্মী ।

সংসদ নেতা , বিরোধীদলীয় নেতা , স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের প্রতিনিধি ছাড়া চেয়ারম্যান , সদস্যসচিবসহ বাকি ৫ জনের নিয়োগের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী , স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের কমপক্ষে ১০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিচারপতির সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হবে । এর চেয়ারম্যান ও সদস্যসচিব হবেন সার্বক্ষণিক , বাকি সাত সদস্য হবেন অবৈতনিক । পুলিশ কমিশনের সদস্যদের কার্যক্ষমতার বিষয়ে বলা হয়েছে , বাহিনীর সদস্যদের অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে শাস্তির মাত্রা নির্ধারণ করে বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা , পুলিশকে বেআইনি প্রভাব বা হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষা প্রদানে নিজ বিবেচনায় নির্দেশনা এবং পুলিশের বিরুদ্ধে নাগরিকদের অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্তের ভিত্তিতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত দেবে কমিশন । এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি , গোষ্ঠী বা মহল কর্তৃক বেআইনি চাপ প্রয়োগ , অবৈধ বা বিধিবহির্ভূত কাজে বাধ্য করা ইত্যাদি বিষয়ে কোনো পুলিশের অভিযোগ আমলে নিয়ে ব্যবস্থা , পুলিশব্যবস্থা সম্পর্কিত বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধানের দুর্বলতা ও অসম্পূর্ণতা চিহ্নিত করে যথাযথ ও যুগোপযোগী করার সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ ও পরিচালনা , অভিযোগের তদন্ত ও অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে কমিশন পুলিশের যেকোনো সংস্থা , এমনকি প্রয়োজন মনে করলে সরকারের সহায়তা গ্রহণের মাধ্যমে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে পারবে । তাদের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাধ্য থাকবে ।