
করোনা মহামারির সময় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে স্থাপন করা ৯৯টি অক্সিজেন জেনারেটর প্লান্টের মধ্যে ২০টির বেশি অকেজো। ১০টির মতো প্লান্ট কখনো চালু করা হয়নি। এর বাইরে অর্ধশত প্লান্ট অচল হওয়ার পথে। যেসব প্লান্ট এখনো সচল, সেগুলো কে চালাবে, কে সারাবে তা কেউ জানে না। কারণ এ ব্যাপারে সরকার থেকে কোনো জনবল নিয়োগ করা হয়নি।
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।
করোনা মহামারির সময় দেশের হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের সংকট দেখা দিলে কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস (ইআরপিপি) প্রকল্পের আওতায় এসব অক্সিজেন জেনারেটর প্লান্ট স্থাপন করে সরকার। গত বছর ডিসেম্বরে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে স্থাপন করা অক্সিজেন জেনারেটর প্লান্টটি এক দিনও চালু করা হয়নি। ঢাকা মেডিক্যালের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রোগীর চাহিদা অনুযায়ী অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। তাই এই প্লান্ট তেমন কোনো কাজে আসছে না। ঢাকার বাইরে ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ডুমুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও প্রায় একই অবস্থা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখানে বড় সমস্যা হলো হাসপাতালগুলো থেকে চাহিদা না নিয়েই মন্ত্রণালয় থেকে চাহিদা তৈরি করা। অর্থাৎ কোনো রকমে প্রকল্প পাস করিয়ে নিজেদের মতো করে দিয়ে দেওয়া হয়। এতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সীমিত টাকার অপচয় হয়ে যায়।’
ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘ইআরপিপি প্রকল্পপত্র তৈরির সময় লোকবলের বিষয় উল্লেখ থাকার কথা, কিন্তু তা করা হয়নি। থাকলে এত দিনে পদ সৃষ্টি ও লোকবল নিয়োগ দুটিই করা যেত। এককথায় বলা যায়, প্রকল্পপত্র ত্রুটিপূর্ণ ছিল।’
ঢাকার বাইরে যেসব হাসপাতালে অক্সিজেন জেনারেটর প্লান্ট বন্ধ রয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে ২৫০ শয্যা লালমনিরহাট হাসপাতাল, ২৫০ শয্যা মেহেরপুর হাসপাতাল, ২৫০ শয্যা ঠাকুরগাঁও হাসপাতাল, ২৫০ শয্যা ফেনী হাসপাতাল, বগুড়া সদর হাসপাতাল, সুনামগঞ্জ জেলা হাসপাতাল, লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল, ৩০০ শয্যা নারায়ণগঞ্জ হাসপাতাল, ২৫০ শয্যা ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাসপাতাল, খুলনার কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
এসব হাসপাতালের দায়িত্বরত ব্যক্তিরা জানান, অক্সিজেন জেনারেটর প্লান্ট চালাতে হলে ২৪ ঘণ্টার জন্য লোকবল দরকার, রক্ষণাবেক্ষণে লোক দরকার, এসবের কোনোটাই সরকার থেকে দেওয়া হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, ‘এ বিষয়গুলো আমাদের জানা নেই। ইআরপিপি প্রকল্প পরিচালক বলতে পারবেন। আমার জানা মতে, এগুলোর সেন্টার লাইনের সঙ্গে সংযোগ নিয়ে কিছু সমস্যা রয়েছে। এ ছাড়া এগুলোর মান কেমন, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে ইআরপিপি প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ গোলাম নবীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিয়ে বন্ধ পাওয়া গেছে।
কেন এই প্রকল্প : হাসপাতালে অক্সিজেন জেনারেটর প্লান্ট থাকলে তা থেকে সরাসরি অক্সিজেন উৎপন্ন হয়। এ ক্ষেত্রে সিলিন্ডার বা তরল অক্সিজেন সরবরাহের প্রয়োজন হয় না। অক্সিজেন জেনারেটর প্লান্ট দুই পদ্ধতিতে কাজ করে। প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে বাতাস থেকে অক্সিজেন আলাদা করা যায়। আবার বাতাসকে প্রসারিত করে অক্সিজেন আলাদা করা যায়। একটি পিএসএ, অন্যটি ভিএসএ। পরিকল্পনা ছিল, একটি অক্সিজেন প্লান্ট থেকে প্রতি মিনিটে ৫০০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন উৎপাদন করা। পরে এই অক্সিজেন দিয়ে কমপক্ষে ৫০ রোগীকে মিনিটে ১০ লিটার নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ করা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, ৯৯টি অক্সিজেন প্লান্টের মধ্যে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ৪০টি স্থাপন করে। এতে ব্যয় হয় ৯২ কোটি ছয় লাখ টাকা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মাধ্যমে কভিড-১৯ সংক্রান্ত সহায়তা তহবিল থেকে ৫১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৯টি এবং জাতিসংঘের অর্থায়নে ৯৭ কোটি পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে ৩০টি অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপন করা হয়।
অক্সিজেনের কাজ কী : অক্সিজেনের প্রয়োজন অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের মতো। অপরিণত নবজাতকের অক্সিজেন লাগতে পারে। ফুসফুসের সমস্যা, বড় ধরনরে অস্ত্রোপচার ও প্রসবের সময় অক্সিজেন লাগতে পারে। সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ টন অক্সিজেন লাগে বলে জানা গেছে।
অক্সিজেনবিষয়ক ল্যানসেট কমিশনের তথ্য মতে, প্রতিবছর বিশ্বের হাসপাতালগুলোতে ৩৭ কোটি ৩০ লাখ মানুষের মেডিক্যাল অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। এদের ৮০ শতাংশ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের মানুষ। এসব মানুষের ৭০ শতাংশ প্রয়োজনের সময় অক্সিজেন পায় না।
প্লান্টগুলো অনেক ক্ষেত্রে বিপজ্জনক : আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) মা ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী আহমদ এহসানূর রহমান অক্সিজেনের ওপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনি জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটের মেডিক্যাল অক্সিজেন সুরক্ষা সম্পর্কিত কমিশন রিপোর্টের নির্বাহী কমিটির সদস্য।
কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, সরকার অক্সিজেন খাতে বিনিয়োগ করছে। তবে বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তেমন বিনিয়োগ দেখা যাচ্ছে না। এসব যন্ত্রপাতি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ও কারিগরিভাবে দক্ষ কর্মী লাগে। বাংলাদেশে এর ব্যাপক ঘাটতি আছে।
তিনি বলেন, ‘অক্সিজেন প্লান্টে বিদ্যুৎ কোথা থেকে আসবে, এর কোনো পরিকল্পনা নেই। প্লান্টগুলো অনেক ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ ছাড়া এটার বড় খরচ রয়েছে। ফলে অনেকেই তা ব্যবহার করে না। এতে অনেক হাসপাতালে স্থাপিত প্লান্টগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এ থেকে উত্তরণে আমাদের একটা জাতীয় রোডম্যাপ থাকতে হবে।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে কালের কণ্ঠের সংশ্লিষ্ট নিজস্ব প্রতিবেদক, আঞ্চলিক অফিস এবং জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিরা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন]