
নানা জটিলতা কাটিয়ে অবশেষে শুরু হতে যাচ্ছে কক্সবাজারের মহেশখালীতে অবস্থিত দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর মাতারবাড়ীর মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজ। অর্থায়ন নিশ্চিত হওয়ায় আগামী অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ জেটি, টার্মিনাল শেড এবং কনটেইনার ইয়ার্ড নির্মাণ শুরু হবে। প্রকল্পটি ২০৩০ সালের মধ্যে পুরোপুরি চালুর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার। বন্দরটি চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়বে সাত গুণ, কনটেইনার হ্যান্ডলিং হবে ১১ লাখ টিইইউএস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একক কনটেইনার)।
ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা অর্থায়ন নিশ্চিত হওয়ায় মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের নির্মাণকাজ শুরু হচ্ছে। এই নির্মাণকাজের জন্য জাপানি উন্নয়ন সংস্থা জাইকা সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে। বাকি এক হাজার কোটি টাকা জোগান দিচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)।
এই প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের জন্য এরই মধ্যে জাপানের পেন্টা ওশান এবং টোয়া করপোরেশন নামের দুটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
জাপানি সংস্থাটি বন্দর নির্মাণের ‘প্যাকেজ-১’-এর অবকাঠামো নির্মাণে অর্থায়ন করবে। এই প্রকল্পের আওতায় ৩০০ মিটার দীর্ঘ মাল্টিপারপাস জেটি এবং ৪৬০ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার জেটি নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া টার্মিনাল ভবন, পেভমেন্ট, সি ওয়াল, রিটেইনিং ওয়াল, ভূমি উন্নয়ন, ড্রেজিং, সৌরবিদ্যুৎসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বোচ্চ ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়তে পারে, যেগুলোতে সাধারণত দুই থেকে আড়াই হাজার কনটেইনার বহন করা যায়। কিন্তু মাতারবাড়ী টার্মিনাল চালু হলে এখানে ১৩ থেকে ১৪ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়তে পারবে, যা সাত থেকে আট হাজার কনটেইনারবাহী বড় জাহাজ। এতে খরচও অনেক কমে আসবে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, এই বন্দর চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়বে সাত গুণ। বন্দরটি ১৪.৫০ মিটার ড্রাফট ও ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যের মোট আট হাজার ২০০ টিইইউস ধারণক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ হ্যান্ডল করতে সক্ষম হবে।
২০২৯ সালের মধ্যে ছয় লাখ থেকে ১১ লাখ টিইইউএস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একক কনটেইনার), ২০৪১ সালের মধ্যে ১৪ লাখ থেকে ৪২ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা যাবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে ৩০ থেকে ৩২ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং সম্ভব হচ্ছে।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ দীর্ঘদিন ধরে আটকে ছিল। অন্তত চার বছর আগে ১৪ মিটার গভীরতা ও ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ নৌ চ্যানেল তৈরি করা হলেও মূল কাজ শুরু করা যায়নি। গত ২২ এপ্রিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পেন্টা ওশান ও টোয়া করপোরেশন নামের দুটি জাপানি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের চুক্তি হয়েছিল। চুক্তির পর পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও বাস্তবে এখনো কাজ শুরু হয়নি। কাজ শুরু না হওয়ার বিষয়ে জানতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাজ শুরুর জন্য খনন জাহাজ ও অন্যান্য উপকরণ এখনো এসে পৌঁছায়নি।
চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা বলেন, ‘আমাদের দেশে বর্ষাকালে কাজ শুরু করা যায় না। শীতকাল টার্গেট ধরে কাজ শুরু করতে অপেক্ষা। তাই আগামী মাসে হয়তো জাহাজ চলে আসবে এবং অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু হতে পারে। আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বছর ৫ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে বৃষ্টিপাত হতে পারে।
জেটি ও টার্মিনাল নির্মাণের জন্য এবং জেটির সামনে জাহাজ ঘোরানোর জন্য কৃত্রিম চ্যানেলটি চওড়া করতে অতিরিক্ত প্রায় ৯ একর জায়গার প্রয়োজন। এর মধ্যে সাড়ে আট একর জায়গার মালিক সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ড। জায়গাটি অধিগ্রহণের জন্য আন্ত মন্ত্রণালয় পর্যায়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হলেও কিছু আইনি জটিলতা রয়েছে। এসব কাজ আগামী মাসের শুরুতে শেষ হয়ে গেলে মাসের শেষার্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু হতে পারে বলে জানা যায়।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের সাবেক পরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য (প্রশাসন ও প্ল্যানিং) জাফর আলম বলেন, বন্দর হিসেবে আনুষ্ঠানিক কাজ শুরুর আগেই মাতারবাড়ীতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লাবোঝাই জাহাজ ভিড়তে শুরু করেছে। এতে করে শুধু পণ্য পরিবহন নয়, পুরো এলাকাতেই পরিকল্পিতভাবে শিল্পায়নের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তিনি আরো বলেন, গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চীন ও ভারত এ ধরনের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ দেখালেও ভূ-রাজনৈতিক জটিলতা এড়াতে শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব দেওয়া হয় জাপানকে। তিনি উল্লেখ করেন, জাপানের ‘বিগ বি’ (বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট) ইনিশিয়েটিভের অন্যতম অংশ হচ্ছে মহেশখালী ও কুতুবদিয়া।
গত ২৩ এপ্রিল চুক্তি অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে দেবে। তিনি বলেন, বন্দরটি চালু হলে প্রায় এক লাখ ডেডওয়েট টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে বলেন, লজিস্টিক সাপ্লাই আরো কার্যকর করতে মাতারবাড়ীতে শিল্প এলাকা বা মেরিটাইম ম্যানুফ্যাকচারিং হাব গড়ে তুলতে হবে।
গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রথম পর্যায়ে পাঁচ হাজার ১০০টি গ্রাউন্ড স্লটসহ মোট ১০ হাজার একক কনটেইনার রাখার টার্মিনাল, অফিস ভবন, পেভমেন্ট, রিটেইনিং ওয়াল, সি ওয়াল, সীমানাপ্রাচীর, ভূমি উন্নয়ন, ড্রেজিং, ল্যান্ড রিক্লেমেশন এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ নির্মাণ করা হবে।
কয়লা বিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করেই মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলার প্রস্তাবনা দেয় জাইকা। যদি যথাসময়ে নির্মাণকাজ শেষ হয়, তাহলে ২০৩০ সালে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে।