Image description

রাষ্ট্র সংস্কারে প্রস্তাবিত জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ স্বাক্ষর আটকে আছে সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায়। একের পর এক বৈঠক করেও সমঝোতায় পৌঁছানো যাচ্ছে না। কমিশনের পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ অনুযায়ী, জুলাই সনদের সাংবিধানিক বিধানগুলো একটি সাংবিধানিক আদেশ জারি ও পরে গণভোটের মাধ্যমে কার্যকর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গণভোট প্রশ্নে কিছুটা কাছাকাছি পৌঁছালেও ভোটের সময় নিয়ে দলগুলোর মধ্যে রয়েছে মতবিরোধ।

আবার সাংবিধানিক আদেশ জারি নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। তবে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো একটি সমঝোতায় পৌঁছাবে বলে আশাবাদী জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন উৎসব মুখর করতে যথাসম্ভব দ্রুত জুলাই সদন স্বাক্ষরের কাজ শেষ করতে চায় ঐকমত্য কমিশন। এরই মধ্যে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করা হয়েছে।

যদিও সেখানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি বা দ্বিমত) রয়েছে। তার পরও অধিকাংশ রাজনৈতিক দল স্বাক্ষরের জন্য প্রতিনিধির নাম পাঠিয়েছে। কিন্তু আলোচনা আটকে আছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে। বাস্তবায়নের সুপারিশ চূড়ান্ত না করে স্বাক্ষর প্রক্রিয়ায় যেতে পারছে না কমিশন।
 
দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে গত ১১ সেপ্টেম্বর ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সংলাপে দ্রুত সমঝোতায় পৌঁছানোর আহবান জানানো হয়। এরপর বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ ও দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে কমিশন। কিন্তু এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।

রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে ঐকমত্য কমিশন জানায়, আইন বিশেষজ্ঞদের প্যানেল প্রস্তাব করেছে, সরকার জুলাই সনদের ২২ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে একটি সাংবিধানিক আদেশ জারি করতে পারে, যেখানে জুলাই সনদে উল্লিখিত মৌলিক সংস্কারগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

এই আদেশ তাৎক্ষণিক কার্যকর হবে। এরপর সেই সাংবিধানিক আদেশের ওপর গণভোট হতে পারে, যা আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিন অনুষ্ঠিত হবে। সাংবিধানিক আদেশে গণভোটের বিধানও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। যদি গণভোটে জনগণের অনুমোদন পাওয়া যায়, তাহলে সাংবিধানিক আদেশ জারির তারিখ থেকে সেটা বৈধতা পাবে।

সূত্র জানায়, কমিশনের এই প্রস্তাব নিয়ে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সংসদ নির্বাচন ও সংবিধান সংশোধন ইস্যুতে গণভোট একই দিন করার বিষয়ে জাতীয় নগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দল আপত্তি জানিয়েছে। তারা গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে তারপর সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। আবার কোনো কোনো দল বলছে, এই মুহূর্তে গণভোটে গেলে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে যাবে। আর আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে নতুন সংকট দেখা দেবে। অবশ্য বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর পক্ষ থেকে সংবিধান সংশোধনী ইস্যুগুলো আগামী সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিয়ে সাংবিধানিক বিষয়গুলো সমাধান এবং সংসদ নির্বাচনের পর গণভোটের পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া কোন প্রশ্নে কিভাবে গণভোট হবে, তা নিয়েও দলগুলোর অবস্থানে এখনো বিস্তর ফারাক রয়েছে।

একাধিক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, সনদের ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। কিন্তু গণভোট হলে কয়টি প্রশ্ন থাকবে, তা পরিষ্কার নয়। কোন প্রশ্নে, কিভাবে গণভোট হবে, সে বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। আবার এটি সময়সাপেক্ষও। গণভোটে নেতিবাচক ফল আসার আশঙ্কাও রয়েছে। গণভোটের রায় প্রস্তাবের পক্ষে না এলে কী হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আবার সংবিধান সংস্কার কার্যকর হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর হবে, সে ক্ষেত্রে কোন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

তবে সময় দ্রুত পার হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সিদ্ধান্তে আসা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা সংবিধান আদেশ-২০২৫ জারির মাধ্যমে নির্বাচনের আগে সংবিধান সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন, যা প্রধান উপদেষ্টাকে জানানো হয়েছে। তবে তিনি রাজনৈতিক দলের সমঝোতা ও ঐকমত্যে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এ নিয়ে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর আবারও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক হবে বলে জানিয়েছে কমিশন সূত্র।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাচন অবশ্যই ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হতে হবে। এর বিকল্প নেই। নির্বাচনের আগে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুতে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়া যেতে পারে। কারণ সনদে এমন কিছু মৌলিক সংস্কারের বিষয় আছে, যা বাস্তবায়নে সংসদীয় গণভোটের প্রয়োজন হবে। তাহলে একই বিষয়ে দুবার গণভোটের প্রয়োজন কেন? তিনি আশা প্রকাশ করেন, আলোচনার মাধ্যমেই সংকটের সমাধান সম্ভব হবে। সংসদ গঠনের পর মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে গণভোট আয়োজনের বিষয়টিও তখন বিবেচনায় আনা যাবে।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোটের প্রস্তাব করা হলেও আমরা চাই, আগেই গণভোট দেওয়া হোক। এতে সংস্কারের বিষয়ে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে।

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণপরিষদ হলো সবচেয়ে ভালো সমাধান। আমরা গণপরিষদ নির্বাচন চাই। তা এই সরকারের মাধ্যমেই করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তন করলে সাংবিধানিক আদেশের প্রয়োজন কী? আবার সাংবিধানিক আদেশের পরিবর্তন করতে চাইলে গণভোটের দরকার কী?

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক আদেশ সমর্থন করে কি করে না, এ প্রশ্নে গণভোটের পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞ প্যানেল। কিন্তু দেশে বর্তমানে গণভোট করার কোনো বিধান নেই। বিষয়টিতে রাজনৈতিক ঐকমত্য হলে সাংবিধানিক আদেশে থাকবে, তখন সরকার এ বিষয়ে গণভোটের আয়োজন করতে পারবে। অথবা আলাদা করে গণভোটের আদেশ দিতে হবে। রাজনৈতিক ঐকমত্য হলে গণভোট হওয়া খুব সহজ। অন্যথায় জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

তবে রাজনৈতিক দলগুলো শেষ পর্যন্ত সমঝোতায় পৌঁছাবে বলে আশাবাদী জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণের স্বার্থে পারস্পারিক আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে এ বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। সাংবিধানিক আদেশের ক্ষেত্রে ঐকমত্যে আসতে পারলে গণভোটের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে পদ্ধতি বের করা যাবে।ঐকমত্য কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক বলেন, ‘সংবিধান সংশোধন ইস্যুতে অনেক বিষয় থাকলেও সেগুলো নিয়ে নানা আলোচনার মাধ্যমে জনগণ জানতে ও বুঝতে পারছে। তবে গণভোটের বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে।’