
অফিসের ভেতরে চলছে ব্যবসা পরিচালনার কার্যক্রম। সাধারণ মানুষের আনাগোনা থাকলেও যে কেউ দেখলে মনে করবে করপোরেট অফিসের কাজে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সবাই ব্যস্ত। তবে বাইরে থেকে স্বাভাবিক মনে হলেও গোপনে অফিসের ভেতরে বৈঠকে চলে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রবিরোধী নানা ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা। যে অফিসটির কথা বলা হচ্ছে সেটি ধানমন্ডিতে অবস্থিত ৬৪/এ শহীদ বুদ্ধিজীবী সড়কে ঢাকা-৭ আসনের সাবেক এমপি, ভূমিদস্যুতাসহ নানা অপরাধের হোতা হাজী সেলিমের মালিকানাধীন মদিনা গ্রুপের করপোরেট কার্যালয় মদিনা স্কয়ার। বর্তমানে অফিসটির সার্বিক পরিচালনার দায়িত্বে আছেন তার এক ছেলে আওয়ামী লীগের নেতা এরফান সেলিম। গত বছরের ৫ আগস্টের পর তিনি পালিয়ে গেছেন ভারতে। বর্তমানে ধানমন্ডির ওই অফিসটির দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন একাধিক মামলার আসামি ও প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এ কে এম ইকবালসহ ৯ জন। তাদের সবার বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে অর্থায়নের অন্তত হাফ ডজন করে মামলা রয়েছে। এরমধ্যে ভাটারা, উত্তরা পশ্চিম থানা, পল্লবীসহ ছয়টি থানার মামলার তদন্ত প্রায় থমকে রয়েছে। সম্প্রতি নয়া দিগন্তের অনুসন্ধান ছাড়াও গোয়েন্দা তথ্য ও একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মদিনা গ্রুপের অফিসে বসে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যারা নিয়মিত বৈঠক করছেন এবং শত কোটি অর্থায়ন করছেন তাদের অন্যতম ও একাধিক মামলার আসামি নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ইকবাল ছাড়াও হাজী সেলিমের পিএস সাহেল হাওলাদার, মদিনা গ্রুপের ট্রেডিং ম্যানেজার সৈয়দ জসিম উদ্দিন, মদিনা গ্রুপের ম্যানেজার (অর্থ) কায়সার হোসেন, মদিনা গ্রুপের পাথর সেকশনের ম্যানেজার শহীদ হাসান খান, মদিনা গ্রুপের রড ম্যানেজার কামরুল হাসান, মদিনা গ্রুপের ম্যানেজম্যান্ট ম্যানেজার হেলাল উদ্দিন ও অফিসের কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন এবং এম আবিদুর রহমান। তাদের ৯ জনের মধ্যে ৮ জনই নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের পদধারী।
২০২০ সালের অক্টোবরে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমেদ খান ও তার স্ত্রীর ওপর হামলা এবং শ্লীলতাহানির ঘটনায় আলোচনায় আসেন সাবেক এমপি হাজী সেলিমপুত্র এরফান সেলিম। এর পর থেকেই নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন তিনি। গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও উল্লেখযোগ্য নেতারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর এরফান সেলিমও ভারতে পালিয়ে যান। বাবা হাজী সেলিম গ্রেফতার হওয়ার পর ভারতে বসে এরফান রাষ্ট্রবিরোধী ভয়ঙ্কর পরিকল্পনায় লিপ্ত হন। সম্প্রতি রাজধানীর ধানমন্ডি, কলাবাগান, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট ও শ্যামলীসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ঝটিকা মিছিল থেকে ককটেল বিস্ফোরণের যে ঘটনা ঘটেছে তার সব পরিকল্পনা হচ্ছে ধানমন্ডিতে এরফান সেলিমের পরিচালিত মদিনা গ্রুপের অফিস থেকে। প্রতি সপ্তাহে দু-একটি মিটিংয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ওই অফিসে বসেই। এরফানের জুম মিটিংয়ে উপস্থিত থাকেন গ্রুপের নির্বাহী পরিচালকসহ ৯ জন। তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় হত্যাচেষ্টা ও অর্থায়নের হাফ ডজন করে মামলা রয়েছে। শুধু তাই নয়, এরফানের নির্দেশে হুন্ডির মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় ১০০ কোটি টাকা অর্থায়ন করা হয়েছে ঝটিকা মিছিল ও দেশবিরোধী কার্যক্রমে। গত শনিবার ভার্চুয়াল বৈঠকে এক সপ্তাহের মধ্যে আরো ১০০ কোটি টাকা দ্রুত দেয়ার জন্য ওই ৯ জনকে নির্দেশ দিয়েছেন এরফান সেলিম। জানা গেছে, আজ শনিবারও ওই অফিসে মিটিংয়ের কথা রয়েছে। তবে পুলিশের কাছে ওই ৯ আসামির তথ্য থাকলেও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাদের গ্রেফতারে কোনো ভূমিকা নিচ্ছে না পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে, ভাটারা থানার ওসি এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলামের সাথে থানায় দেখা করে আসছেন তিন আসামি। এরপর মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে আসছেন তারা। এভাবে অন্তত চারটি থানাকে অর্থের বিনিময়ে আসামিরা ম্যানেজ করে প্রতি সপ্তাহে মিটিং মিছিলের পরিকল্পনা চালিয়ে যাচ্ছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ধানমন্ডির মদিনা স্কয়ারের মিটিং রুমে বসে দফায় দফায় মিটিংয়ের পর আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিলে অর্থায়নের করার অভিযোগ রয়েছে। ওই অফিস থেকেই ধানমন্ডি, কলাবাগান, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট ও শ্যামলীসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ঝটিকা মিছিল থেকে ককটেল বিস্ফোরণ ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ ঢাকার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে পরিকল্পনা করা হয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতাকর্মীরা অনেকেই রয়েছেন ভারতে। সেখানে প্রতিদিনই তারা ভার্চুয়াল মিটিংয়ে অংশ নিচ্ছেন। ওই মিটিং থেকে দেশকে অস্থিতিশীল করতে নানা পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে মদিনা গ্রুপের ধানমন্ডির ওই করপোরেট ভবনে সেখানকার কর্মকর্তাদের মাধ্যমে দিকনির্দেশনামূলক কার্যক্রম ভার্চুয়াল বৈঠকে চালিয়ে যাচ্ছেন হাজী সেলিমপুত্র এরফান। তারা শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরাতে ভয়ঙ্কর পরিকল্পনায় বিপুল পরিমাণ অর্থায়ন করছে। হুন্ডির কথা বলে নগদ অর্থ পৌঁছে দিচ্ছেন অজ্ঞাত আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্ত নেতাকর্মীদের কাছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মদিনা স্কয়ারের ওই ভবনের তিনতলায় বসে চলে মিটিংয়ের কার্যক্রম। মিটিং শুরুর আগে অফিসের সব সিসি ক্যামেরা বন্ধ করা হয়। ওই সময় চারতলায় অফিস কার্যক্রম পুরোদমে চলতে থাকে। এ ছাড়াও গ্রুপের অভিযুক্ত কর্মকর্তারা ক্যাডার বাহিনী গঠন করেছে। তাদের রয়েছে টর্চারসেল। যাদের সন্দেহ করা হয় তাদের ক্যাডার গ্রুপের সহায়তায় তুলে নিয়ে চালানো হয় বেদম মারধরের পর নির্যাতন।
এ বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বৃহস্পতিবার নয়া দিগন্তকে বলেন, রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম যারা করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। কার্যক্রম নিষিদ্ধ কোনো দল বা দুষ্কৃতকারীরা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইলে তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হবে। তিনি বলেন, ধানমন্ডির মদিনা গ্রুপ অফিসে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমের ঘটনা ঘটে থাকলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আইজিপি বলেন, ঝটিকা মিছিল ও ককটেল বিস্ফোরণের প্রস্তুতির সময় ২৪৪ জন নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন এবং পরিকল্পনাকারীর তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশ সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে বলে তিনি জানান। এ ছাড়া এসব তৎপরতায় পুলিশের কোনো সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ থাকলে সে ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।