
গাজীপুর শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে উত্তর-পূর্ব সীমান্তের উপজেলা কাপাসিয়া। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক তাজউদ্দীন আহমদের স্মৃতিবিজড়িত এই উপজেলার মানুষ তুলনামূলক অনেকটা শান্তিপ্রিয়। দুপুরের পর উপজেলা সদর থেকে চার কিলোমিটার দূরত্বে দুর্গাপুর ইউনিয়নের রাওনাট বাজারে ঢুকতেই চোখে পড়লো চায়ের দোকান ঘিরে জনাপাঁচেক মানুষের জটলা। কেউ চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছেন, কেউ খোশগল্পে মেতে আছেন। সত্তরোর্ধ্ব চা দোকানি আলী আকবর মোল্লা সুর মেলান আড্ডায়। নির্বাচন প্রসঙ্গ তুলতেই অভিমানের সুরে তিনি বলেন, গত ১৭ বছর ভোট দিতে যাইনি ইচ্ছে করে। কারণ ভোটকেন্দ্রে ঢোকার পরই জোর করে আঙুলে টিপ নিয়ে নিতো। আমার ভোট যদি আমি না দিতে পারি তাহলে আমার ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কী দরকার। আওয়ামী লীগ আমলের ভোটের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পর পুলিশ আমাকে জিজ্ঞেস করে নৌকায় ভোট দিবো কিনা, তখন আমি না বললে পুলিশ বলে, আপনার ভোট দেয়ার দরকার নাই। চলে যান। পরে চলে আসছি। এই দুঃখে পরে আর ভোট দিতে যাইনি। তবে এবার আশাকরি সেই পরিস্থিতি হবে না। ভোটকেন্দ্রে যাবো, নিজের স্বাধীন মতো ভোট দিবো। যদি একই পরিস্থিতি হয় তাহলে এবারো ভোট দিতে যাবো না। হুজুররা পিআর টিআর চাইলেও লাভ হবে না। এবার পিআর টিআর হবে না। সাধারণ মানুষ এসব বুঝে না। তিনি বলেন, এবার মানুষ প্রার্থী দেখে ভোট দেবে। দলের চেয়ে যোগ্য প্রার্থী মানুষ দেখবে।
একই আড্ডায় যোগ দেন প্রবাসফেরত ষাটোর্ধ্ব ফজলুল হক। তিনি বলেন, আমাদের চাওয়া একটি সুষ্ঠু ভোট। ভোট নিয়ে হানাহানি যেন না হয়। সবাই যেন নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে। কোনো দল যদি শেখ হাসিনার মতো জোর করে ভোট নিতে চায়, আর হাসিনার মতো জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চায় তাহলে পরিণতিও তার মতো হবে। মানুষ পিটিয়ে দেশছাড়া করবে। তবে সবাই ভোটকেন্দ্রে যাবে। কিছু আওয়ামী লীগ নেতা রয়েছে যাদের পদপদবি আছে তারা হয়তো ভোটকেন্দ্রে যাবে না। কিন্তু যাদের পদপদবি নেই আওয়ামী লীগ সমর্থন করেন তারা ভোট দিতে যাবে।
রাওনাট বাজারে শেষপ্রান্তে দেখা মেলে আরেকটি চায়ের আড্ডা। সেখানে আড্ডা দিচ্ছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীর লোকরা। পঞ্চাশোর্ধ সুভাষ চন্দ্র দাস বলেন, হিন্দু সমপ্রদায়ের লোকজন এখন নীরব ভূমিকা পালন করছেন। তারা রাজনৈতিক কোনো ঝুট-ঝামেলায় যায় না। এসব এড়িয়ে চলেন। তবে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ থাকলে হিন্দু সমপ্রদায়ের লোকজনও ভোটকেন্দ্রে যাবেন। যারাই দাঁড়াবেন তাদের মধ্যে থেকে একজন ভালো লোক দেখে ভোট দিবেন। নির্বাচন হবে কিনা সন্দেহ প্রকাশ করেন ষাটোর্ধ্ব পবিত্র কুমার দেব। তিনি বলেন, সরকার তো নির্বাচন দিচ্ছে না। নির্বাচন হলে আমাদের সমপ্রদায়ের মানুষজনও ভোট দিতে যাবে। হিন্দু সমপ্রদায়ের লোকজনকে নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, একটা কথা প্রচলন রয়েছে- হিন্দু সমপ্রদায়ের লোকজন অন্য দলকে ভোট দিলেও বলে সে তো আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। এটা ঠিক না। বাংলাদেশে কতো পারসেন্ট হিন্দু আছে। বেশির ভাগই তো মুসলিম। হিন্দুদের ভোটে তো সরকার হয় না। তবে পিআর পদ্ধতি সম্পর্কে তারা অবগত নন বলে জানান তিনি।
রাওনাট বাজার থেকে ৩ কিলোমিটার পূর্ব দিকে রানীগঞ্জ বাজার। বাজারের মাঝামাঝি ঢুকতেই চোখে পড়লো আরেকটি চা দোকানের আড্ডা। ১০-১২ জন বিভিন্ন বয়সের লোকজন সেখানে আড্ডা দিচ্ছেন। ত্রিশোর্ধ্ব যুবক আলমগীর হোসেন অনেকটা রাখঢাক না করেই বলেন, সত্যি কথা বলতে কি আমি আওয়ামী লীগ করলেও গত ১৭ বছর দেশে সুষ্ঠু ভোট হয়নি। সাধারণ মানুষ ভোট দিতে পারে নাই। আমিও চাই এবার একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। কোনো পিআর টিআর নয়, সুষ্ঠু ভোটে যেই নির্বাচিত হবে সেই ক্ষমতায় আসবে।
রানীগঞ্জ থেকে দুই কিলোমিটার উত্তর দিকে ফুলবাড়িয়া বাজারের ইউনুস মার্কেট। সেখানে একসঙ্গে বসে কথা বলছিলেন বেশ কয়েকজন। সেখানে কথা হয় ষাটোর্ধ্ব আবদুস সামাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, যেদিন ভোটের তারিখ ঘোষণা হবে সেদিন বিশ্বাস করবো। এতদিন শুধু চেয়ারম্যান নির্বাচনের ভোট দিতে পেরেছিলাম। কিন্তু এমপি নির্বাচনের ভোট দিতে পারি নাই। এবার অবশ্যই ভোট দিতে যাবো। সাধারণ মানুষও ভোট কেন্দ্রে যাবে।
উপজেলাটিতে ভোটার রয়েছে ৩ লাখ ২৬ হাজার। ১১টি ইউনিয়নে গ্রাম রয়েছে ২৩১টি। প্রবাসী অধ্যুষিত এই উপজেলাটিতে তেমন শিল্পকলকারখানা না থাকলেও ডেইরি ফার্ম ও পোল্ট্রি ফার্ম রয়েছে। ৫ই আগস্টের পর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ১১টি। এদিকে মনোনয়ন লড়াইয়ে ভোটের মাঠে রয়েছেন বিএনপি’র ৪ জন, জামায়াতের একজন, এনসিপি’র একজন প্রার্থী। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের বাইরে পাঁচবার বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিএনপি তিনবার, একবার জাতীয় পার্টি ও একবার কমিউনিস্ট পার্টি জয়লাভ করেন। বাকি সাতবার আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা এমপি নির্বাচিত হন। প্রথমবার সংসদ সদস্য হন তাজউদ্দীন আহমদ। গত বছরের ৪ ও ৫ই আগস্ট কাপাসিয়ায় আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও নেতাদের বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলেও ওইদিন কাপাসিয়া উপজেলা সদরে তাজউদ্দীন চত্বরে প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ম্যুরালে আঘাত করেননি কেউ। উল্টো তাজউদ্দীনের ম্যুরালে ফুলের মালা দেন ছাত্র-জনতা। তাজউদ্দীন আহমদকে এখনো কাপাসিয়ার আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতসহ দলমত নির্বিশেষে শ্রদ্ধা করেন। সর্বস্তরের মানুষ তাকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখেন। তাজউদ্দীন চত্বরেই বিএনপি-জামায়াতের নেতারা দলীয় সভা-সমাবেশ করেন।