Image description
হাসিনাকে তারেক সিদ্দিকীর পরামর্শ, ‘গ্যাং অব ফোর’ ছিলেন-ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান ও আসাদুজ্জামান খান কামাল

গুলি চালিয়ে কিছু লোক মেরে ফেললে বিক্ষোভ এমনিতেই দমন হয়ে যাবে। জুলাই আন্দোলনে গত বছরের ৪ আগস্ট রাতে শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে এমন পরামর্শ দেন তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকী। তিনি সেনাবাহিনী দিয়ে আন্দোলনকারীদের দমনের জন্যও বলেন হাসিনাকে। ওই রাতে ‘গ্যাং অব ফোর’ নামে পরিচিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শেখ হাসিনাকে কঠোর অবস্থানে যেতে বলেছিলেন। এর ফলে শেখ হাসিনার নির্দেশে পরদিন ৫ আগস্ট ঢাকাসহ সারা দেশে শত শত আন্দোলনকারীকে গুলি করে গণহত্যা চালানো হয়। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর আগমুহূর্ত পর্যন্ত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ক্ষমতায় থাকার সব ধরনের অপচেষ্টা করেন। ৪ আগস্ট রাতের বৈঠকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি সামনে এলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলতে থাকেন, যা হওয়ার হবে। তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না। শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে শক্ত হয়ে, মেরুদণ্ড শক্ত করে কঠোর হয়ে বিক্ষোভ দমনের নির্দেশ দেন।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগে (ফরমাল চার্জ) এমন তথ্য উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন।

এ মামলার একমাত্র আসামি হাসানুল হক ইনু। তার বিরুদ্ধে ৮টি অভিযোগ আনা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ৩৯ পৃষ্ঠার। এতে ২০ জনকে সাক্ষী রাখা হয়েছে। আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর এ মামলায় ইনুকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ এই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন। জুলাই আন্দোলন দমনে হত্যাযজ্ঞ ছাড়াও পিলখানা হত্যাকাণ্ড, বিরোধীদের দমনে বিচারপতিদের পুরস্কার প্রদান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসনকে সাজা দিয়ে দুই বিচারপতির উপঢৌকন গ্রহণ, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা, বিচারপতি খায়রুল হকের প্রতারণাসহ ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের নানা অপকর্ম উঠে আসে ফরমাল চার্জে।

এতে বলা হয়, আন্দোলন চলাকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও ১৪ দলীয় জোটের নেতারা দলগতভাবে সিদ্ধান্ত নেন দেশব্যাপী মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করার। ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক ছিল হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদও আন্দোলন দমনে সর্বাত্মকভাবে কাজ করে।

ফরমাল চার্জে উল্লেখ করা হয়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন বিরোধী দল জাসদের প্রায় ৪০ হাজার নেতাকর্মীকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকার হত্যা করে, শত শত লোককে বিনা বিচারে আটক রাখে। হাজার হাজার লোক নির্যাতনের শিকার হয়। এমনকি বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে জাসদপ্রধান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিলকে প্রকাশ্য কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনে পরাজিত ঘোষণা করা হয়। এখানেই শেষ নয়। শুধু ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য জাসদের অতীত ভুলে গিয়ে আসামি হাসানুল হক ইনু শেখ হাসিনা সরকারের জনবিরোধী নীতি প্রকাশ্যে সমর্থন করতে থাকেন।

ফরমাল চার্জ থেকে জানা যায়, ১৪ দলীয় জোটপ্রধান তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ জুলাই গণভবনে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। সেখানে আন্দোলনকারীদের রাজাকার, রাজাকারের বাচ্চা ও রাজাকারের নাতি-পুতি বলে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি আন্দোলন দমনে ড্রোন, হেলিকপ্টার ও মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান করেন। শেখ হাসিনা ও তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির ফোনালাপ থেকে জানা যায়, শেখ হাসিনা আন্দোলন দমনে পুলিশ, বিজিবি মোতায়েনসহ আন্দোলনকারীদের হত্যার নির্দেশনা আগেই দিয়ে রেখেছিলেন।

চার্জে বলা হয়, ২০১১ সালে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল ঘোষণা করেন। তিনি শেখ হাসিনার ক্ষমতাকে স্থায়ীকরণের লক্ষ্যে ২০১১ সালের ১০ মে সংক্ষিপ্ত আদেশে যে রায় প্রদান করেন। পরে তিনি তা পরিবর্তন করে সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা করেন। এর পুরস্কার হিসাবে অবসর গ্রহণের পর তাকে ‘আইন কমিশন’-এর চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়। একইভাবে বিচার বিভাগের কর্মরত অন্য বিচারকদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে বিচার বিভাগকে কলুষিত করেন।

এতে বলা হয়, বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামান সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট’ মামলায় ৫ বছর এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় ৭ বছর সাজা প্রদান করেন। এর জন্য এই বিচারককে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় হাইকোর্টে খালেদা জিয়াকে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ৫ বছরের সাজাকে ১০ বছরে উন্নীত করেন। উপহার হিসাবে তাকে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এমনকি ব্রিটেনের নাগরিক আওয়ামী লীগ নেতা এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে বিচারপতি নিয়োগ করা হয়।

অভিযোগে আরও বলা হয়, গত সরকারের আমলে বিচার বিভাগ হয়ে উঠেছিল বিরোধী দল ও বাকস্বাধীনতা দমনের মুখ্য হাতিয়ার। এ সময়ে মানবাধিকারকর্মী আদিলুর রহমান খান শুভ্র, এএসএম নাসির উদ্দিন এলান, সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানসহ অনেককে মিথ্যা মামলায় হাজতবাস ও কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ কুমার সিনহা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন। এ কারণে তৎকালীন ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে নির্যাতনের পর জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করে।

বিচারপতি শাহেদ নূর উদ্দিন, বিচারপতি ইমরুল কায়েসসহ অনেক বিচারপতি তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর রায় ও আদেশের মাধ্যমে বিচার বিভাগীয় দমন, পীড়ন চালান। পরে তারা সরকারের আস্থাভাজন হিসাবে পরিচিতি পেয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বিচারপতি এনায়েতুর রহিম, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি আবু আহম্মেদ জমাদ্দার প্রকাশ্যে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বিধি ও প্রথা ভঙ্গ করে রাজনৈতিক সংবর্ধনা গ্রহণ করেন।

চার্জে আরও বলা হয়, ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে শেখ হাসিনার সরকার সেনাবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করতে ক্ষমতা গ্রহণের পরই ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় অবস্থিত বিডিআর সদর দপ্তরে তথাকথিত বিদ্রোহের নামে সেনাবাহিনীর ৫৭ জন দেশপ্রেমিক চৌকশ সেনা অফিসারসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্রোহকালীন অবরুদ্ধ কর্মকর্তাদের উদ্ধার করতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তথাকথিত আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে হত্যাকাণ্ডকে নির্বিঘ্ন করতে সুযোগ করে দেয়। জনগণের জোরালো দাবির মুখে বিডিআর বিদ্রোহের বিষয়ে একটি প্রহসনমূলক তদন্ত কমিশন গঠন করে ষড়যন্ত্রের হোতাদের বাদ দিয়ে একটি মনগড়া রিপোর্ট প্রকাশ করে।