
Farid Uddin Rony(ফরিদ উদ্দিন রনি)
লাল বৃত্তে চিহ্নিত করা ব্যক্তিটি হলেন সোয়েব আব্দুল্লাহ। বর্তমানে নেপাল বাংলাদেশ দূতাবাসের ডিপুটি চিফ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিসংখ্যান বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী তিনি। ফজলুল হক মুসলিম হলের ২০০৯-১০১২ সালে ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের সেন্ট্রাল কমিটিতেও দায়িত্বে ছিলেন। হলে বহু শিক্ষার্থীকে নির্যাতন চালিয়েছে শিবির ও ছাত্রদল ট্যাগ দিয়ে। গতকাল নিউইয়র্কের ঘটনায় তাকে নিয়ে তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে তার বিভাগের দু’জন পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। যারা তার খুব কাছের ছিল।
ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে সে নিজেকে ছাত্রলীগের ডাইহার্ড কর্মী প্রমাণ করতে সিনিয়রদের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ভয়াবহ নিপিড়ন চালাতো ‘শিবির’ কিংবা ‘ছাত্রদল’ এসব ট্যাগ দিয়ে।
২০০৭ সালের এক নবাগত শিক্ষার্থীকে কুরআন পড়তে দেখায় ফজলুল হক হলের গেস্টরুমে ডেকে এনে শিবির ট্যাগ দিয়ে পায়ে রড ঢুকিয়ে দিয়ে সারারাত নির্যাতন করে।
‘সোচ্চার’ থেকে ভ্যারিফাই করা মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের ১১-১২ সেশনের আরেকজন নির্যাতিত শিক্ষার্থীর জবানবন্দিতে জানলাম, তাকেও শিবির বানিয়ে রাতভর নির্যাতন করে আধমরা অবস্থায় সকালে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এই শোয়েব নাকি সিগারেটের আগুনে ছেঁকা দিয়ে নির্যাতন করেছিল সারারাত। আরও কয়েকজন জুনিয়রকে দিয়ে স্ট্যাম্প, লাঠিসোঁটা দিয়ে পিটাইছে তাকে।
৩৩তম বিসিএসে ঢাবির সাবেক ভিসি আরেফিন সিদ্দিককে দিয়ে কল দিয়ে ভাইবা বোর্ডে ২০০ তে ১৮০ ভাগিয়ে নেয় শোয়েব। ঐটা আবার ফ্রেন্ডদের বলে ফ্লেক্স নিতো।
সরকারি কর্মকর্তা হয়েও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে একটিভলি জড়িত ছিলেন। শেখ হাসিনার অনুগত ছিলো।হাসিনার শেষ সময়ে তাকে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ দূতাবাসে পাঠানো হয়।
গণঅভ্যুত্থানের সময়ে হাসিনার পুলিশলীগের হত্যাযজ্ঞের প্রতি সমর্থন জানিয়ে নানা পোস্ট করেছিল।
৫ আগস্ট হাসিনার পতন ঘটলে তার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে সব এক্টিভিটিজ মুছে ফেলেন৷ এরপর তার আইডিও ডিঅ্যাক্টিভ করে ফেলেন।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইন্টেরিম সরকার তাকে নিউইয়র্ক থেকে শিফট করায় নেপাল দূতাবাসে। বর্তমানে সে কাগজেকলমে নেপাল বাংলাদেশ মিশনের ডেপুটি চিফ। কিন্তু অবস্থান করছেন নিউইয়র্কে। রাষ্টদূতকে দিয়ে অর্ডার ক্যান্সেল করে নিউইয়র্কে থেকে যেতে ট্রাই করেছিল।
নিউইয়র্ক মিশন থেকে তাকে শিফট করানো হলেও তার কানেকশন থেকে যায়। রাষ্ট্রদূত সালাহউদ্দিন নোমান তাকে নিউইয়র্কে নিয়ে এসে প্রধান উপদেষ্টার এই গুরুত্বপূর্ণ সফরে রাজনৈতিক নেতাদের প্রটোকলে কো-অর্ডিনেশনের দায়িত্ব রাখেন।
এবার আসি গতকালের মূল ঘটনায়।
প্রথমে দূতাবাস থেকে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের জানানো হয় ৮ নম্বর টার্মিনাল দিয়ে বের হবেন প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীরা। ফলে, তারা আগে থেকেই ৮ নম্বর টার্মিনালে অপেক্ষারত ছিলেন অতিথিদের ওয়েলকাম জানাতে। কিন্তু বিমান ল্যান্ড করার কিছুক্ষণ পর দূতাবাস থেকে তাদেরকে জানানো হয় আপনারা চলেন যান, প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী সবাই উনার সঙ্গে ভিভিআইপি গেইট দিয়ে এক্সিট করবেন।
এই তথ্য শোনে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মী বাসায় বেক করতে থাকেন। এরমধ্যে ডিসিশন হয় রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ প্লাস প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ ও সহকারী প্রেস সচিব তিথিসহ ৪ নম্বর টার্মিনাল দিয়ে বের হবেন।
কেন এই সিদ্ধান্ত, এটা রহস্যজনক! যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হইছে প্রফেসর ইউনূস ট্রাই করেছেন তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে বের হতে, বাট ভিসা জটিলতায় তাদেরকে সঙ্গে যেতে দেওয়া হয় নাই।
এরমধ্যে তাহের সাহেব উনার দলের কয়েকজন কর্মীকে কল দিলে তাদের বেশকিছু নেতাকর্মী ৪ নম্বর টার্মিনালে তাৎক্ষণিকভাবে চলে আসেন।
মির্জা ফখরুল, আবদুল্লাহ তাহের, আখতার ও তাসনিম জারা যখন টার্মিনাল ৪ দিয়ে এক্সিট করছেন তখন জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা বাইরে থেকে ওয়েলকাম জানান তাদেরকে। এরমধ্যে তারা সামনে আগালে তাদের ঘিরে মানববেষ্টনী তৈরি করে সামনে এগোতে থাকে নেতাকর্মীরা, কিন্তু ফখরুল সাহেবকে প্রটোকল থেকে টেনে নিয়ে যায় নেপাল দূতাবাসের ডিপুটি চিফ এই ছাত্রলীগ সাবেক নেতা শোয়েব। ফখরুল সাহেব যেতে চান নাই৷ উনি পেছনে ঘুরে তাহের সাহেবকে দেখিয়ে একসঙ্গে যেতে দাঁড়ালেন। কিন্তু শোয়েবের সঙ্গে নিউইয়র্ক দূতাবাসের আরও ২জন কর্মকর্তা (দুজনের ব্যাকগ্রাউন্ড লীগ) তাকে টেনে গেইট থেকে বের করে ফেলে।
আচমকা পরিস্থিতির শিকার ফখরুল সাহেব সামনে পা বাড়ালে আখতার ও জারা তাকে অনুসরণ করে হাঁটেন। এদিকে পেছনে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা মানববেষ্টনি তৈরি করে তাহেরকে মাঝখানে রেখে ‘তাহের ভাই, তাহের ভাই’ স্লোগান দিতে দিতে আস্তে আস্তে সামনে এগোতে থাকে।
ফখরুল, আখতার এবং জারাকে একা পেয়ে গেইটের বাইরে লীগের মাস্তানেরা অপদস্থ করে। একটা ছেলেকে দেখা যায় গা ঘেঁষে এই যে ফখরুল, ফখরুল বলে তুইতোকারি করে হেনস্থা করতে৷ আরেকজন তাসনিম জারকে ম-বর্গীয় ও চ-বর্গীয় গালি দিতে থাকে। জুলাই স-ন্ত্রা-সী, রাজাকার বলে দুইজন ডিম ছুঁড়ে আখতারের জামায়। আশেপাশে অনেকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে তাদের।
দূরে থাকা জামায়াত নেতাকর্মী, যারা তাহের সাহেবকে ঘিরে রেখে স্লোগান দিচ্ছিলেন তারা খবর পেয়ে (কিংবা বুঝতে পেরে) দৌড়ে কয়েকজন সামনে এসে প্রটেক্ট করে ফখরুল সাহেব, আখতার ও জারাকে সেইফলি গাড়িতে তুলে দেন। এই সময় তাদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডাও হয় লীগের মাস্তানদের সঙ্গে। একাধিক ভিডিওতে দেখা যায় শিবিরে সাস্ট শাখার এক সাবেক নেতা তর্কাতর্কি করছেন লীগের টোকাইদের সঙ্গে।
ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শোয়েব আবদুল্লাহ নেপাল দূতাবাসের কর্মকর্তা হয়ে কীভাবে নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন এবং প্রধান উপদেষ্টার সফরে বিমানবন্দরে এক্সিটে প্রোটোকলে কো-অর্ডিনেশনের দায়িত্ব ছিলেন?
এক্সিটের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে যখন ৮ নম্বর টার্মিনাল থেকে ৪ নম্বর টার্মিনাল দিয়ে বের করা হলো অতিথিদের, সেই তথ্য লীগ কিভাবে ইমিডিয়েটলি পেয়ে গেল, যেখানে বিএনপি-জামায়াতকে জানানোই হলো না?
তারমানে এই সব কিছু শেয়াবের মতো সাল আরও যেসব লীগের ল্যাসপেন্সার ঘাপটি মেরে বসে আছেন দূতাবাসে, তাদের পরিকল্পনামাফিক হয়েছে? সাবেক লীগ নেতা শোয়েব আবদুল্লাহ আগে থেকে ইনফর্ম করে রেখেছে লীগের মাস্তানদের, তাই নয় কী? এবং ফখরুল সাহেব, আখতার ও তাসনিম জারাকে জামায়াতের নেতাকর্মীদের ভীড় থেকে আলাদা করে দ্রুততম সময়ে কেন টেনে নিয়ে গেইটের বাইরে আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দিল?
প্রশাসনের সবখানে এখনো লীগের ল্যাসপেন্সাররা বহাল তবিয়তে আছেন। ‘ক’ কে শিফট করে ‘খ’ এর জায়গায় নিচ্ছে, ‘খ’ কে ‘ক’-এর জায়গায়। সর্ষের ভেতর ভূত রেখে এভাবেই চলছে ইন্টেরিম সরকারের রাষ্ট্র সংস্কার!