Image description
কেয়া কসমেটিকস

রপ্তানি আয়ের বিপুল অর্থ নিজেদের ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্টে জমা হয়নি বলে দাবি করেছে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘কেয়া কসমেটিকস’ লিমিটেড। উল্টো প্রতিষ্ঠানটি এখন আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণে জর্জরিত। গত ২০ বছরে রপ্তানি আয়ের ৬৬ কোটি ডলার বা প্রায় আট হাজার কোটি টাকা কয়েকটি ব্যাংক থেকে কেয়া গ্রুপের ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্টে (এফসি) জমা হয়নি এমন অভিযোগ করে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলকে (এফআরসি) চিঠি দিয়েছে শিল্প প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তাকেও এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে এ পর্যন্ত প্রত্যাশিত সাড়া মেলেনি বলে দাবি করেছেন কেয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান। বিপুল পরিমাণ এই অর্থের দায় দেনা নিয়ে কেয়া গ্রুপ ও ব্যাংকগুলো পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করে আসছে। অভিযোগের বিষয়ে এফআরসিতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তবে কোনো সুরাহা মেলেনি। কেয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক পাঠান মানবজমিনকে জানিয়েছেন, রপ্তানি আয় এফসি অ্যাকাউন্টে জমা না হওয়ার বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকে হয়ে আসছে। আগের সরকারের সময়ে নানা কারণে তারা এটিকে সামনে আনতে পারেননি। উল্টো নানা হয়রানির শিকার হয়েছেন। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরই রপ্তানি আয় না পাওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানানো হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত কোনো পদক্ষেপ নেই। তদন্তের উদ্যোগও দায়সারা মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, ব্যাংকের লেনদেনের সব তথ্য সংরক্ষিত থাকে। বিষয়টি তদন্ত করলে সবকিছু বের হয়ে আসবে। কিন্তু ১০ মিনিটের এই কাজটি ১০ বছরেও করা হচ্ছে না। কেয়া গ্রুপের অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান মানবজমিনকে বলেন, কেয়া কসমেটিক অনেক দিনের পুরনো কোম্পানি। তারা রপ্তানি করে। সেই টাকা তাদের ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা হয় না, বিষয়টি হাস্যকর। তারপরও কোনো ব্যাংক যদি না করে থাকে অভিযোগ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। 
কেয়া গ্রুপ সূত্র জানায়, রপ্তানি আয়ের ডলার ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্টে জমা হওয়ার কথা। এই অর্থ থেকে ডলারে আমদানি ব্যয় মেটানোর পর বাকি অর্থ কোম্পানির অ্যাকাউন্টে জমা হওয়ার কথা। কিন্তু ব্যাংকগুলো এই ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্টে অর্থ জমা না করে সরাসরি অ্যাকাউন্টে জমা করেছে। যা ঋণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কেয়া গ্রুপের কাছে ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ এখন ২৭০০ কোটি টাকা। 

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর কেয়া গ্রুপের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেয়। এই শিল্প গ্রুপের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনা তদন্ত করতে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) একটি নিরীক্ষা (অডিট) ফার্ম নিয়োগ দিয়েছে। এই ফার্ম কার্যক্রম চালাচ্ছে। অন্যদিকে এফআরসি ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিকে ডেকে কথা বলেছে। 

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরকে লেখা চিঠিতে কেয়া গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হয়, রপ্তানি আয়ের বিপুল অঙ্কের ডলার এফসি অ্যাকাউন্টে জমা না করায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে কর্মরত প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক ও কর্মীর মধ্যে ১০০০ জন প্রতিবন্ধী কর্মী আছে যাদের বেকার হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি শ্রম মন্ত্রণালয়কেও অবহিত করা হয়েছে। এ ঘটনায় কোম্পানির প্রায় ৫০ হাজার শেয়ারহোল্ডার বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলেও কেয়া গ্রুপের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়। 

চিঠিতে কেয়া গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্ত চাওয়ায় ব্যাংকগুলো সব ধরনের সুবিধা (আমদানি-রপ্তানি) কার্যক্রম কেয়া গ্রুপের সঙ্গে বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ ব্যাংকগুলোর কাছে এ প্রতিষ্ঠানের পর্যাপ্ত বন্ধক আছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের উদ্যোগের কারণে রপ্তানি আয় বন্ধ হয়ে প্রতি মাসে গড়ে ১ কোটি মার্কিন ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের রিজার্ভ। যদিও এই সংকটকালে রিজার্ভ বৃদ্ধি খুবই প্রয়োজন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে লেখা চিঠিতে বলা হয়, সাউথইস্ট ব্যাংকের মাধ্যমে ২০০৪-২০২৩ সাল পর্যন্ত কেয়া কসমেটিক্স বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মোট বিদেশে পণ্য রপ্তানি করেছে ১০১ কোটি ৯৬ লাখ মার্কিন ডলারের। ব্যাংক এ রপ্তানির পুরো অর্থ আদায় করলেও ৩৯ কোটি ৪৬ লাখ মার্কিন ডলার কোম্পানির এফসি অ্যাকাউন্টে জমা করেনি। এই পণ্য রপ্তানির বিপরীতে বিটুবি আমদানি ছিল ৮০ কোটি ডলার। ব্যাংক এই ৮০ কোটি ডলারের হিসাবটি ফোর্স লোন সৃষ্টি এবং পরবর্তী সময়ে মেয়াদি ঋণ সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকে দেয়া চিঠিতে আরও বলা হয়, ২০০৭-২০২৩ সাল পর্যন্ত পূবালী ব্যাংকের মাধ্যমে কেয়া গ্রুপ ২০ কোটি ১৯ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। ব্যাংক সে অর্থ আদায় করলেও কোম্পানির এফসি অ্যাকাউন্টে কোনো অর্থ জমা করেনি। এই পণ্য রপ্তানির বিপরীতে বিটুবি আমদানি ছিল ৫.৩২ কোটি ডলার। এ হিসাবটি ব্যাংকের পক্ষ থেকে ফোর্স লোন সৃষ্টি এবং পরে মেয়াদি ঋণ সৃষ্টি করে।

এ ছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংকের মাধ্যমে ২০০৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত ৭ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানির পর সেটি পুরোপুরি আদায় হয়। কিন্তু ব্যাংক ৫ কোটি ৮৫ লাখ ডলার এফসি অ্যাকাউন্টে জমা করেনি। এই পণ্য রপ্তানির বিপরীতে বিটুবি আমদানি ছিল ৩.৪৫ কোটি ডলার। 

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে ২০০৮-২০১৪ সাল পর্যন্ত কেয়া গ্রুপ ৬৫ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করলেও এফসি অ্যাকাউন্টে কোনো পরিমাণ অর্থ জমা দেয়নি। এই পণ্য রপ্তানির বিপরীতে বিটুবি আমদানি ছিল ৪১ লাখ মার্কিন ডলার। এই হিসাবটি ব্যাংকের পক্ষ থেকে ফোর্স লোন সৃষ্টি এবং পরে টার্ম লোনে রূপান্তর করে ব্যাংক। 

কেয়া গ্রুপ যে অভিযোগ করেছে তা অস্বীকার করে আসছে ব্যাংকগুলো। এফআরসি’র বৈঠকেও ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা নিজেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সত্য নয় বলে জানান। 

কেয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক পাঠান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের রপ্তানি আয়ের ৬৬ কোটি ডলার সংশ্লিষ্ট ব্যাংক আমাদের এফসি অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করেনি। এটি করে দিলে ব্যাংকের পাওনা প্রায় ২৭শ’ কোটি টাকার দায় থাকবে না। তিনি বলেন, আমাদের রপ্তানি আয় সম্পূর্ণ ডলার এফসি অ্যাকাউন্টে জমা করতে ব্যর্থতার কারণে ব্যাংকগুলো বিটুবি/আমদানি পরিশোধের জন্য ফোর্স লোন এবং পরবর্তী সময়ে টার্ম লোনে কনভার্ট করে। আমি এর তদন্তের জোর দাবি জানাচ্ছি। ব্যাংকগুলো মুখে বলছে- আমাদের অভিযোগের সত্যতা নেই। কিন্তু তারা কোনো ডকুমেন্ট দিচ্ছে না। ব্যাংকে সব লেনদেনের তথ্য সংরক্ষিত থাকে। 

ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল চেয়ারম্যান ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, রপ্তানি আয় ও ব্যয়ের হিসাব নিয়ে বোঝাপড়ার গ্যাপ হয়েছে। এই গ্যাপটা খুঁজে বের করাই আমাদের কাজ। এফআরসি এসব অভিযোগের বিষয় তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে।