Image description

যুক্তরাজ্যের সম্পত্তি বাজারের অর্থের উৎস নিয়ে দশকের পর দশক ধরে অস্পষ্টতা থেকেই গেছে। এখানকার লাল ইটের অট্টালিকা আর চকচকে অফিস ভবনগুলো যেন দায়মুক্তির স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এই দায়মুক্তি হলো বছরের পর বছর ধরে অবৈধ অর্থে গড়ে তোলা সম্পত্তি ও এতে জড়িতদের জবাবদিহির মুখোমুখি না করা। তবে বাংলাদেশ থেকে শুরু করে মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন সংস্থাগুলো তদন্ত ও বিচারের উদ্যোগ নেওয়ায়, যুক্তরাজ্য নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তারা এখন হিসাব কষতে বাধ্য হচ্ছে যে, কীভাবে তারা ক্লেপ্টোক্রাটস বা পাচারকারীদের অর্থের আস্তানায় পরিণত হলো।

পাচারের অর্থে যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি গড়ে তোলার ঘটনা নিয়ে সোমবার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট। এতে বলা হয়েছে, লন্ডন কীভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আশপাশের অঞ্চলের দুর্নীতির অর্থের নিরাপদ ঠিকানা হয়েছে- তা নতুন করে সামনে আসে মালয়েশিয়ার একটি তদন্ত শুরুর পর।

মালয়েশিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের লন্ডনভিত্তিক সম্পত্তির উৎস নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। যদিও মাহাথির বলেছেন, এটি কোনো অবৈধ সম্পত্তি নয়। তবে গত জুনে মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশনের (এমএসিসি) অনুরোধে প্রয়াত ধনকুবের ও মাহাথিরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী দাইম জায়নুদ্দিনের প্রায় ১৮ কোটি ডলার মূল্যের সম্পত্তি ফ্রিজ করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। জব্দ হওয়া সম্পত্তির মধ্যে আছে, লন্ডন সিটি এলাকার দুটি বাণিজ্যিক ভবন, মেরিলেবোন ও বেইজওয়াটার এলাকার বিলাসবহুল বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট।

 

মালয়েশিয়া থেকে যুক্তরাজ্যের রিয়েল এস্টেট খাতে অর্থ পাচারের ঘটনা নতুন কিছু নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ অর্থ প্রায়ই বৈধ সম্পদের সঙ্গে মিশে যায়। শেল কোম্পানি ও অফশোর কাঠামোর মাধ্যমে এই অর্থ এমনভাবে সরানো হয় যে উৎস জানার উপায় থাকে না।

২০২০ সালে মার্কিন কর্তৃপক্ষ জানায়, যুক্তরাজ্যে প্রায় ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পত্তি কেনা হয়েছে লুটের অর্থে। যে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছিল ওয়ানএমডিবি নামে মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ তহবিল থেকে। যা যুক্তরাজ্যে ঢোকানো হয় ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের মাধ্যমে। যুক্তরাজ্যের অঞ্চল হিসেবে পরিচিত এই দ্বীপপুঞ্জ বিশ্বে ‘ট্যাক্স হেভেন’ নামে পরিচিত। যেখানে করের হার প্রায় শূন্য এবং খুব কঠোরভাবে আর্থিক গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়।
 
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আজমি হাসান বলেন, মালয়েশিয়ার অভিজাতদের কাছে সম্পদ রাখা বা কেনার জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য হলো লন্ডন। দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণেও অভিজাতরা যুক্তরাজ্যে সম্পত্তির মালিক হওয়ার ক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

যুক্তরাজ্যে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়াই একমাত্র দেশ নয়। এ তালিকায় আছে বাংলাদেশও। গত মে মাসে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) প্রায় ৯ কোটি পাউন্ড মূল্যের বিলাসবহুল সম্পত্তি জব্দ করে। সন্দেহ করা হচ্ছে এই সম্পত্তি বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের। পরে যুক্তরাজ্যের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল তদন্ত করে প্রায় ৪০ কোটি পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি পায়। যেগুলো শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে আছে, মে ফেয়ার ম্যানশন, সারে কাউন্টির এস্টেট ও মার্সিসাইডের ফ্ল্যাট।

এসব ঘটনার প্রভাব পড়েছে যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতেও। সম্পত্তিগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পর শেখ হাসিনার ভাতিজি টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রীর পদ হারিয়েছেন। এক বিবৃতিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, বছরের পর বছর ধরে অলিগার্ক ও স্বৈরশাসকদের জন্য আমরা লাল গালিচা বিছিয়ে রেখেছি। যাতে তারা তাদের সম্পদ নিয়ে এ দেশে আসে। 

এশিয়াজুড়ে এমন আরও ঘটনা আছে। সিঙ্গাপুরে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনায় এক চীনা নাগরিককে গত বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এতে অভিযুক্তদের মধ্যে দুজন অফশোর কোম্পানি ব্যবহার করে লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটে ৫৬ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি কেনেন। 

অবৈধ সম্পত্তি থাকার এমন নিয়মিত অভিযোগ উঠলেও যুক্তরাজ্য বেশ ধীর গতিতে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, ক্যারিবীয় সাগরের পাঁচটি অঞ্চল যেমন—কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ ও ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ এখনও বৈশ্বিক মানি লন্ডারিং চক্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গত ৩০ বছরে এসব অঞ্চলের মাধ্যমে ৭৯টি দেশ থেকে প্রায় ২৫০ বিলিয়ন পাউন্ড অবৈধ অর্থ পাচার হয়েছে।