Image description

নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া পেছনে দেশি-বিদেশি শক্তির ইন্ধন থাকার দাবি সত্য নয়। রবিবার (২১ সেপ্টেম্বর) চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মো. মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ আসামিপক্ষের জেরায় এ কথা বলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম।

জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিচার চলছে ট্রাইব্যুনালে। মামলার তিন আসামির মধ্যে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান পলাতক।

তাদের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী হলেন মো. আমির হোসেন। আরেক আসামি সাবেক পুলিশ প্রধান (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে। সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরার সময় তাঁকে ট্রাইব্যুনালে আসামির কাঠগড়ায় তোলা হয়। তিনি এ মামলায় দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হয়েছেন।

গত ২ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা-কামালের বিরুদ্ধে তিনি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন। প্রসিকিউশনের ৪৭তম সাক্ষী হিসেবে গত ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন নাহিদ ইসলাম। পরে তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী আমির হোসেন। 
জেরায় এই আইনজীবী নাহিদের কাছে জানতে চান, দেশি-বিদেশি শক্তির ইন্ধন ছিল বিধায় আপনারা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন? জবাবে নাহিদ ইসলাম বলেন, এ কথা সত্য নয়।

গত বছর ৩ আগস্ট সরকার পতনের এক দফা কর্মসূচি ছিল তাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার ফলশ্রুতি, আইনজীবীর এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, ‘এটা সত্য নয়।’ এরপর আরেক প্রশ্নে নাহিদ বলেন, ‘এও সত্য নয় যে, আন্দোলনের (কোটা সংস্কার বা সরকার পতনের আন্দোলন) পেছনে দেশি-বিদেশি শক্তির হাত ছিল।’

এ সময় প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনকে চ্যালেঞ্জ করার কোনো সুযোগ নেই। এটা রাষ্ট্রের বৈধতা রয়েছে। আর এ বিষয়ে আপিল বিভাগ অনুমোদন দিয়েছেন।

এখানে বিচার হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধের। সরকারের বৈধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন আসতে পারে না। মামলা সম্পর্কিত কথা বলাই উত্তম। তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, এর সঙ্গে এটা প্রাসঙ্গিক।’
এ সময় শেখ হাসিনার আইনজীবী বলেন, ‘ড. ইউনূসকে জড়িয়ে কোনো কথা বলা সমীচীন মনে করি না। কিন্তু সাক্ষীর বক্তব্যের খাতিরে বলতে হচ্ছে।’ জেরায় আমির হোসেনে দাবি করেন, গত বছরের ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি। তিনি ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। 

জবাবে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘এটা সত্য নয় যে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করেন নাই। এটাও সত্য নয় যে শেখ হাসিনা বাধ্য হয়ে ভারতে চলে যান নাই।’

শেখ হাসিনা ও কামালকে নির্দোষ দাবি করে আমির হোসেন বলেন, ‘আন্দোলন দমনে হেলিকপ্টার ও মারণাস্ত্র ব্যবহারের কোনো নির্দেশ দেননি শেখ হাসিনা। মূলত জনগণের জানমাল ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। তাই এই আসামিরা অপরাধের জন্য দায়ী নন। জবাবে নাহিদ ইসলাম বলেন, এসব সত্য নয়।

জেরায় নাহিদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, জুলাই আন্দোলনে তার ওপর চলা অত্যাচারের জন্য কোনা মামলা করেছেন কি না। জবাবে নাহিদ বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে যেসব অন্যায় হয়েছে, সেসব সমগ্র জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘঠিত অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। এসব অন্যায় শুধুমাত্র ব্যক্তিগতভাবে আমার বিরুদ্ধে করা হয়েছে বলে আমি মনে করিনি। সেজন্য ব্যক্তিগতভাবে কোনো মামলা করিনি। তবে গুমের ঘটনায় গুম কমিশনে আলাদা অভিযোগ দিয়েছি

 
বিচার প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ ও দোসরদের নিষিদ্ধ করতে হবে

জেরা শেষে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন নাহিদ ইসলাম। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের কাছে এখন যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ এসেছে। আমরা ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন জানাব। কারণ রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে দলীয় প্রধান হিসেবে জনগণকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এই মামলায় ব্যক্তি হিসেবে শেখ হাসিনাকে আসামি করে মামলা চলমান। আমি মনে করি এটা শুধু ব্যক্তির সংঘটিত অপরাধ নয় বরং এটা রাজনৈতিক অপরাধ। তাই জনগণই প্রতিরোধ করে তাকে উৎখাত করেছে। ফলে বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার দোসরদের চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে।’

জেরায় আসামিপক্ষের আইনজীবীর প্রশ্ন নিয়ে জানতে চাইলে নাহিদ বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে গুলি চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এক দফা ঘোষণা করে তাকে উৎখাত করার প্রস্তুতি নেওয়া ছিল বৈধ। এখানে ষড়যন্ত্রের কিছু নেই। জনগণের অভ্যুত্থান হিসেবে জুলাই আগস্ট সংঘটিত হয়েছে। এখানে দেশি-বিদেশি শক্তির কোনো ইন্ধন ছিল না। জনগণ স্বতস্ফুর্তভাবে রাজপথে নেমে এসেছিল। জীবন দিয়ে প্রতিরোধ করে সফলতা নিয়ে এসেছে। শেখ হাসিনাসহ অন্যরা বিচারের মুখোমুখি হতে ভয় পেয়ে দেশত্যাগ করেছে। দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।’

নাহিদ ইসলামের জেরা শেষ হলে এই মামলায় সাক্ষ্য দেন নতুন রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ বাংলাদেশ) প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ। তিনি তার সাক্ষ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিচার দাবি করেন।

সরকার পতনের এক দফা দাবির ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ছিলেন জুনায়েদ। ৪ আগস্টের বর্ণনায় তিনি বলেন, এদিন যাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলন চলাকালীন পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ সম্মিলিতভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। এই হামলায় অনেকেই হতাহত হয়। পরদিন ৫ আগস্টের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির সময় সাদ্দাম মার্কেট থেকে কাজলা ফুটওভার ব্রিজের সামনে আন্দোলনকারীদের ওপর স্নাইপার রাইফেল দিয়ে মাথায় গুলি করা হয়। মাথায় গুলিবিদ্ধ প্রায় ১৫ জনকে তিনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেখেছেন বলে ট্রাইব্যুনালকে জানান জুনায়েদ। এরপর এই সাক্ষীকেও জেরা করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। সোমবারও তাকে জেরা করা হবে।