
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে টানাপড়েন। বিএনপি ও সমমনা জোটসহ কয়েকটি দল আলোচনার টেবিলে থেকে সমঝোতার পথ খুঁজছে, অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ অথবা গণভোট ছাড়া কোনো সমাধান মানতে রাজি নয়। ওদিকে, গণপরিষদের দাবিতে এখনো অনড় অবস্থানে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। গণঅধিকার পরিষদ বলছে-রাজনৈতিক দলগুলোর শতভাগ ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়, তাই এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব সরকারের। অন্যদিকে, নতুন উদ্যোগ বা প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার গণতন্ত্র মঞ্চের ছয়টি দলের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) ও গণঅধিকার পরিষদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। সূত্র জানায়, বৈঠকে কীভাবে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়নের জন্য দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে আনা যায় এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানা যায়, সরকারের কাছে একাধিক প্রস্তাব রাখতে চায় তারা। বিশেষজ্ঞদের মতামতে গণভোট করা সম্ভব। বাস্তবায়নের ক্ষমতা বা দায়িত্ব কমিশনের নেই। জুলাই সনদ তৈরি করা ও পরামর্শ দেয়ার দায়িত্ব কমিশনের। তবে এর বাস্তবায়ন সরকারকেই করতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গত বুধবারের আলোচনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সনদের সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো সংবিধান আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নে মত দিয়েছে বিশেষজ্ঞ প্যানেল। তারা বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকার সনদের মূল সংস্কারগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে একটি ‘সংবিধান আদেশ’ (কনস্টিটিউশন অর্ডার) জারি করতে পারে। এ আদেশ তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে। এতে গণভোটের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট হবে। জনগণের সমর্থন পেলে তা জারির তারিখ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে।
একাধিক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সনদের ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। এরমধ্যে অনেকগুলো বিষয়ে নোট অব ডিসেন্টও রয়েছে। এতগুলো নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে কীভাবে গণভোট হবে। তবে গণভোট হলে কয়টি প্রশ্ন থাকবে, তা স্পষ্ট নয়। এটি সময়সাপেক্ষও। গণভোটে নেতিবাচক ফল আসার আশঙ্কাও করেছেন কেউ কেউ। বিএনপিসহ তার সমমনা দলগুলো সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিয়ে সাংবিধানিক বিষয়গুলো সমাধানের পরামর্শ দিয়েছে।
কমিশন সূত্র আরও জানায়, বিশেষজ্ঞ প্যানেলের পরামর্শে জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট করার জন্য বলা হয়েছে। সেটি হবে সাংবিধানিক আদেশ সমর্থন করে কি করে না- এমন প্রশ্নে। দেশে বর্তমানে গণভোট করার কোনো আইন না থাকায়, যদি বিষয়টিতে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়, তখন সাংবিধানিক আদেশে থাকবে, সরকার এ বিষয়ে গণভোটের আয়োজন করতে পারবে। অথবা আলাদা করে গণভোটের আদেশ দেয়া হতে পারে। রাজনৈতিক ঐকমত্য হলে বিষয়টির সমাধান এবং জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট প্রক্রিয়ার আয়োজন করা সহজ হবে। সে ক্ষেত্রে গণভোটের প্রশ্নের বিষয়ে কমিশন থেকে বলা হচ্ছে, সরকার সাংবিধানিক আদেশ দিয়ে সংবিধানের কিছু অংশ পরিবর্তনে প্রস্তাব করেছে। আপনি কি সেটি সমর্থন করেন কিনা? এ রকম প্রশ্ন হতে পারে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ মানবজমিনকে বলেন, সরকারের কাছে একাধিক প্রস্তাব রাখতে চায় কমিশন। বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মতামত আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে জানিয়েছি। এটার পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দিয়েছে দলগুলো। আমরা সেগুলো নোট করেছি। সেগুলো আবার বিশেষজ্ঞ প্যানেলকে আমরা জানিয়েছি। গতকাল বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে বসেছিলাম।
তিনি বলেন, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য তাদেরকে জানিয়েছি। এগুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞরা পর্যালোচনা করবেন। রাজনৈতিক দলগুলোকে বলেছি, আপনারা নিজেদের মধ্যে বসে প্রস্তাবগুলো এক বা একাধিক প্রস্তাবে আনতে পারেন কিনা। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য সময় প্রয়োজন। এজন্য আমরা একটু বড় আকারে গ্যাপ দিয়েছি।
বিশেষজ্ঞদের মতামত প্রসঙ্গে ড. আলী রীয়াজ বলেন, তারা তাদের সমন্বিত সুস্পষ্ট মতামত দিয়েছেন। সেটি আমরা সবাইকে দিয়েছি। তারা বলছেন, তাদের বিবেচনায় গণভোট করা সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলো বক্তব্যের প্রেক্ষিতে পর্যালোচনা করবেন জন্য গতকাল আবার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসেছি। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বিকল্প প্রস্তাব যদি কমিয়ে আনতে পারেন, তাহলে কমিশনের জন্য সুবিধা হয়।
তিনি বলেন, বাস্তবায়নের ক্ষমতা বা দায়িত্ব কমিশনের নেই। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা একাধিক প্রস্তাবের পরামর্শ দিতে চাই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা ফলপ্রসূ হবে আশাবাদ ব্যক্ত করে আলী রীয়াজ বলেন, যে বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা আরেক দফা আমাদের জানাবেন- কীভাবে অগ্রসর হওয়া যায়।
সনদের বাস্তবায়নের পদক্ষেপের বিষয়টি সরকারকেই নিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জুলাই সনদ তৈরি করা ও পরামর্শ দেয়ার দায়িত্ব ঐকমত্য কমিশনের। কিন্তু বাস্তবায়ন সরকারকেই করতে হবে। দলগুলোর অবস্থান প্রশ্নে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি বলেন, অনেকগুলো প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন ছিল। তবে আমরা তাদেরকে একটা জায়গায় নিয়ে এসেছি। অনেকগুলো বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও এখন আমরা একটা জায়গায় এসেছি। সনদ নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলছেন না। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতের কথা বলছেন, সেটা আমরা এক জায়গায় আনতে চেষ্টা করছি।
আলী রীয়াজ বলেন, কমিশন কোনো কিছু চাপিয়ে দেবে না এই কথা অনেকবার বলেছি। কমিশনের কাজ হলো সুপারিশ করা, বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। দলগুলোকে যেমন- কোনোকিছু চাপিয়ে দেইনি। সরকারকেও ঠিক কোনোকিছু চাপিয়ে দিতে চাই না যে-এভাবেই বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হতে হবে। যদি নির্বাচন ঝুলে যায় বা অনিশ্চিত হয়, তবে এর সুযোগ নেবে অসাংবিধানিক শক্তি। আমরা আলোচনায় আছি, সমাধানের জন্য প্রস্তাব দিচ্ছি। কিন্তু যদি বিলম্ব হয়, তবে তার বেনিফিশিয়ারি হবে পতিত ফ্যাসিবাদ।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যারা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, জনগণ তাদের প্রতিরোধ করবে। সরকারের ভেতরে যারা ড. ইউনূসকে কুপরামর্শ দিচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করা হবে। নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন মানবজমিনকে বলেন, সংবিধানের মৌলিক যে বিষয়গুলোতে সংশোধনী আনতে হবে। যেগুলোর সংশোধনী আনলে আর সংবিধানের চরিত্রই পাল্টে যাবে। যেকোনো সংশোধনীর মাধ্যমে আনলেও কোর্টে চ্যালেজ্ঞের সুযোগ থেকে যায়। সংবিধান সভা বা গণপরিষদই উত্তম ও গণতান্ত্রিক উপায়। যার মধ্যেদিয়ে ভবিষ্যতে যেকোনো বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, যদি জনগণ গণভোটে জুলাই সনদ প্রত্যাখ্যান করে, তবে করণীয় কী? দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাবে না, বাস্তব সিদ্ধান্ত সরকারের হাতেই। সরকার চাইলে সহজেই সমাধান দিতে পারেন, কিন্তু তারা দায় নিতে চাইছে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো বিভক্ত। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনাও কোনো সুনির্দিষ্ট সমাধান আনতে পারেনি। পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে নির্বাচনী অনিশ্চয়তা বাড়বে।