
চলতি বছরের জুলাইয়ে দেশের আমদানি তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। মূলত ডলার সংকট কাটিয়ে ওঠা ও আমদানি নীতি শিথিলতা করার কারণে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকলিত তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে আমদানিকারকরা ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছেন। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।
এর আগে, ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল। এরপর থেকে আমদানি কমতে থাকে, যা এ বছর আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছর জুলাইয়ে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কারণে বাণিজ্য অনেকটা থমকে গিয়েছিল। তাই এবার স্বাভাবিক ব্যবসা ফিরেই আমদানিতে বড় বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।
আমদানির এই বৃদ্ধির মূল কারণ হলো বেশি করে কাঁচামাল আনা। যেমন তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল, লোহা, ইস্পাতসহ অন্যান্য ধাতু ও যন্ত্রপাতি।
সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহিয়া জুনেদ বলেন, এ অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানি বাড়ার মূল কারণ হলো শিল্প খাতে চাহিদা ফের বেড়ে যাওয়া। বিশেষ করে যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের আমদানি নীতিমালা নিয়ন্ত্রণ শিথিল হওয়ার পর আবার বেড়েছে।
'গত দুই বছরে সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে এলসি অনুমোদন কঠোর করেছিল এবং রিজার্ভ বাড়াতে বিদেশি মুদ্রা সংরক্ষণে গুরুত্ব দিয়েছিল। এখন এসব নীতিমালা কিছুটা শিথিল হওয়ায় ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করছে। এছাড়া বিশ্ব বাজারে দাম বেড়ে যাওয়া ও টাকার দুর্বলতার কারণে আমদানি খরচ আরও বেড়েছে,' বলেন তিনি।
'এই বৃদ্ধির কারণ হলো ব্যবসা ও উৎপাদন, সাধারণ মানুষের কেনার কারণে নয়।'
ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এটি শিল্প খাতের জন্য ইতিবাচক দিক।
তিনি আরও বলেন, 'গত বছরের জুলাই ও আগস্টে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বন্দর বন্ধ থাকায় আমদানি হিসাব ঠিকমতো দেখা যায়নি।'
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরীও একই মত প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, 'এ বছরের জুলাই মাসের সঙ্গে গত বছরের একই সময়ের তুলনা করলে বড় ধরনের বৃদ্ধি দেখা যাবে। কিন্তু এটা আসলে সত্যিকারের প্রবৃদ্ধি নয়, বরং ব্যবসা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার চিত্র।'
তিনি আরও বলেন, 'বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ এখনও কম, এলসি খোলা কমেছে, আর বড় মেশিনের আমদানি কয়েক বছর ধরে কমছে।'
জুলাই মাসে ব্যবসায়িক ঋণ ৬ দশমিত ৫২ শতাংশ বেড়েছে। যা আগের মাসের চেয়ে সামান্য বেশি। তবে এটি ছিল অন্তত দেড় বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি। আর বেসরকারি খাতের ঋণ জাতীয় বিনিয়োগের দুই-তৃতীয়াংশের সমান।
তিনি বলেন, 'ঋণ প্রবৃদ্ধির এই পরিসংখ্যান বার্তা দিচ্ছে যে, বিনিয়োগে আগ্রহ সেভাবে বাড়েনি। তাই পরিসংখ্যান ইতিবাচক মনে হলেও আমাদের বুঝতে হবে অর্থনীতি এখনো স্থিতিশীলতার পর্যায়ে আছে, বাড়ছে না।'
তথ্য বলছে, মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি (যার মধ্যে পোশাক শিল্পের কাঁচামালও আছে) জুলাই মাসে আগের বছরের তুলনায় ২১ শতাংশ বেড়ে ৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি ৭১ শতাংশ বেড়ে ৪৫৬ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা এতদিন কমছিল।
পোশাক-সংক্রান্ত আমদানি ১০ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে এ বছরের জুলাইয়ে ১ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, এই পুনরুদ্ধারের একটি মূল কারণ হলো কিছু কারখানায় বহু বছরের অপেক্ষার পর গ্যাস সংযোগ পাওয়া, যার ফলে তারা উৎপাদন শুরু করতে পারছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজর (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, আমদানি তথ্যে দেখা যায়, দেশে ভোক্তা পণ্যের চাহিদা কমছে, সম্ভবত দাম বেশি থাকার কারণে। কিন্তু মূলধনী যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি বাড়ছে। এতে বোঝা যায়, আমদানি নিয়মকানুন কিছুটা সহজ হয়েছে ও ২০২৪ সালের জুলাইয়ের রাজনৈতিক সমস্যা ও বন্ধ থাকার পর অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।
তিনি আরও বললেন, কাঁচা তুলার আমদানি কমছে, কিন্তু সুতার আমদানি বাড়ছে, যার মানে স্থানীয় কারখানাগুলোর বাজার অংশ কমছে।