
আরব ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো যদি সমন্বিতভাবে ইসরায়েলের জন্য আকাশপথ অবরোধ করে, তবে তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত প্রভাব কী হতে পারে—সে বিষয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মালিকানাধীন একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান।
গত বুধবার আল হাবতুর রিসার্চ সেন্টার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, ৯ সেপ্টেম্বর কাতারের রাজধানী দোহায় ইসরায়েলের হামলাই এমন সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রেরণা বা অনুঘটক হতে পারে।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের নেতাদের লক্ষ্য করে চালানো ওই হামলায় ছয়জন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন কাতারের নিরাপত্তা কর্মকর্তা। তবে হামাসের কোনো শীর্ষ নেতা নিহত হননি।
গত সোমবার কাতারের রাজধানীতে জরুরি বৈঠকে বসে ৫৭ সদস্যের ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ও আরব লীগ। বৈঠকে ইসরায়েলের হামলার জবাবে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
আল হাবতুর রিসার্চ সেন্টারের বিশ্লেষণে বলা হয়, ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের জন্য দেশটির বিরুদ্ধে আকাশপথে অবরোধ আরোপ করা হলে তেল আবিবের অর্থনীতির নানা খাতে ভয়াবহ ক্ষতি হবে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর ফলে ইসরায়েলের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৪ দশমিক ৮ থেকে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এতে দেশটি মন্দার মুখে পড়বে।
গবেষণাকেন্দ্রটির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আরব ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সমন্বিত আকাশপথ অবরোধে নতুন আঞ্চলিক নিরাপত্তাকাঠামো তৈরি হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র একটি কূটনৈতিক সংকটে পড়বে। দেশটিকে ইসরায়েলকে বাঁচানো আর আরব দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্ব—দুটির একটি বেছে নিতে হবে।
ওআইসির বড় বড় সদস্য যেমন তুরস্ক, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া যদি এ অবরোধে যোগ দেয়, তবে ইসরায়েল এশিয়া ও আফ্রিকার প্রবৃদ্ধিশীল বাজারগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হারাবে। এতে পূর্ব ও দক্ষিণমুখী ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাবে।
প্রতিবেদন বলছে, বিকল্প রুটে যেতে হলে প্রতিটি ফ্লাইটের সময় চার থেকে ছয় ঘণ্টা বাড়বে। এতে প্রতি ফ্লাইটে ৩০ হাজার থেকে ৬০ হাজার ডলার পর্যন্ত খরচ বাড়তে পারে। ইসরায়েলের বিমান সংস্থা এল-আলের আয়ের ৬০ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। আর এটা ‘রক্ষণশীল অনুমান’।
আকাশপথ অবরোধে ইসরায়েলের পর্যটনশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হীরার মতো উচ্চ মূল্যের ও চিকিৎসা সরঞ্জামের মতো সময়-সংবেদনশীল পণ্যের রপ্তানিও ব্যাহত হবে।
এমন পরিস্থিতিতে অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি বাতিল হতে পারে এবং ইসরায়েলভিত্তিক গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম অন্যত্র চলে যেতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনীতির বাইরে এ ধরনের পদক্ষেপ পুরো অঞ্চলের ভূরাজনীতির চিত্র মৌলিকভাবে পাল্টে দেবে।

বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলো এবং এদের মধ্যে কাতার দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রকে প্রধান নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক অংশীদার হিসেবে দেখে আসছে।
তবে যেদেশে আট হাজারের বেশি মার্কিন সেনা রয়েছেন, সেই দেশেই ইসরায়েলের হামলা ঠেকাতে ওয়াশিংটন ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতার পর অনেকেই বলছেন, এখন সময় এসেছে কৌশলগত অংশীদারত্বকে বৈচিত্র্যময় করার অর্থাৎ শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর না করে, নিরাপত্তা ও কূটনীতির জন্য অন্য দেশ বা শক্তির সঙ্গেও অংশীদারী গড়ে তোলার।
আমরা এখানে অস্ত্রশিল্প গড়ে তুলব। আমরা হব একদিকে এথেন্স, অন্যদিকে সুপার স্পার্টা। আগামী কয়েক বছরে আমাদের আর কোনো বিকল্প থাকবে না। নিজেদের রক্ষা করতে হবে, শত্রুকে আঘাত করার সক্ষমতাও অর্জন করতে হবে।
গবেষণাকেন্দ্রটির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আরব ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সমন্বিত আকাশপথ অবরোধে নতুন আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র একটি কূটনৈতিক সংকটে পড়বে। দেশটিকে ইসরায়েলকে বাঁচানো আর আরব দেশগুলোর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারত্ব—এই দুটির একটি বেছে নিতে হবে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ সপ্তাহের শুরুতে বলেছেন, দেশটি এখন বিশ্বমঞ্চে ‘অন্তরিণ’ হয়ে পড়েছে এবং দেশটিকে ‘স্বনির্ভর অর্থনীতি’র দিকে যেতে হবে।
নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমি মুক্তবাজারে বিশ্বাসী। কিন্তু আমরা এমন অবস্থায় যেতে পারি, যেখানে আমাদের অস্ত্রশিল্পের রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আমাদের এখানেই নতুন অস্ত্রশিল্প গড়ে তুলতে হবে—শুধু গবেষণা নয়, উৎপাদনের সক্ষমতাও তৈরি করতে হবে।’
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা এখানে অস্ত্রশিল্প গড়ে তুলব। আমরা হব একদিকে এথেন্স, অন্যদিকে সুপার স্পার্টা। আগামী কয়েক বছরে আমাদের আর কোনো বিকল্প থাকবে না। নিজেদের রক্ষা করতে হবে, শত্রুকে আঘাত করার সক্ষমতাও অর্জন করতে হবে।’
ওআইসির বড় বড় সদস্য যেমন তুরস্ক, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া যদি এ অবরোধে যোগ দেয়, তবে ইসরায়েল এশিয়া ও আফ্রিকার প্রবৃদ্ধিশীল বাজারগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হারাবে। এতে পূর্ব ও দক্ষিণমুখী ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাবে।
এথেন্স ও সুপার স্পার্টা প্রসঙ্গ টেনে নেতানিয়াহু বোঝাতে চাইছেন, ইসরায়েলকে একই সঙ্গে জ্ঞান–বিজ্ঞান ও গবেষণার কেন্দ্র (এথেন্সের মতো) এবং অতি শক্তিশালী সামরিক রাষ্ট্র (সুপার স্পার্টার মতো) হয়ে উঠতে হবে। সেই সঙ্গে পারস্যের সঙ্গে প্রাচীন গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলোর যুদ্ধের দিকে ইঙ্গিত করেন তিনি।
এ মন্তব্য এসেছে এমন এক সময়ে, যখন গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার পর দেশটির বিরুদ্ধে ইউরোপের কয়েকটি দেশ অস্ত্র ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ডাক দিয়েছে।
‘কার্যকর চাপের হাতিয়ার’
গবেষণাকেন্দ্রের প্রতিবেদনে আকাশপথ অবরোধকে বলা হয়েছে ‘গ্রে জোন’। অর্থাৎ শান্তি ও পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের মাঝামাঝি অত্যন্ত চাপ সৃষ্টিকারী এক পদক্ষেপ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি ইসরায়েল জোর করে এ অবরোধ ভাঙতে চায়, তবে তা আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকি বাড়াবে। এতে উপসাগরীয় দেশগুলো, ইরান এবং ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোও জড়িয়ে পড়তে পারে।
শুরু থেকেই আমি বলেছি, আমরা আরবেরা এমন অর্থনৈতিক শক্তির মালিক, যাকে হেলাফেলা করা যাবে না। আজ আমি বলছি, আমাদের হাতে কার্যকর চাপের হাতিয়ার আছে, যা এক ফোঁটা রক্ত না ঝরিয়েও ইসরায়েলের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
আরেকটি সম্ভাবনা হলো, এ অবরোধ ইসরায়েলকে উত্তেজনা কমাতে ও কিছু ছাড় দিতে বাধ্য করতে পারে। তবে প্রতিবেদনে এটিকে কম সম্ভাবনাময় বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আকাশপথ অবরোধ শিকাগো কনভেনশনের ৯ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করতে পারে। ওই ধারায় বলা আছে, সামরিক প্রয়োজনে বা জননিরাপত্তার কারণে আকাশপথ বন্ধ করা যায়, তবে তা বৈষম্যমূলক হতে পারবে না এবং নির্দিষ্ট কোনো দেশের নাগরিকদের লক্ষ্য করতে পারবে না।
অবরোধকারী দেশগুলো যুক্তি দেখাতে পারে, ইসরায়েলের দোহায় হামলা তাদের নিরাপত্তায় গুরুতর হুমকি তৈরি করেছে। তবে ইসরায়েল ও তার মিত্ররা আইনি চ্যালেঞ্জ জানাবে বলেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে প্রতিবেদনে এটাও বলা হয়েছে, বাস্তবে আরব ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর তরফে এমন সমন্বিত অবরোধ আরোপের সম্ভাবনা কম। কারণ, এতে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হবে এবং অবরোধকারী দেশগুলোর নিজেদেরও অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে।
আল হাবতুর রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছেন ধনী আমিরাতি ব্যবসায়ী খলাফ আহমদ আল হাবতুর।
গত বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে খলাফ আহমদ লিখেছেন, ‘শুরু থেকেই আমি বলেছি, আমরা আরবরা এমন অর্থনৈতিক শক্তির মালিক, যাকে হেলাফেলা করা যাবে না। আজ আমি বলছি, আমাদের হাতে কার্যকর চাপের হাতিয়ার আছে, যা এক ফোঁটা রক্ত না ঝরিয়েও ইসরায়েলের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।’
খলাফ আহমদ বলেন, তাঁর গবেষণাকেন্দ্রের প্রতিবেদন প্রমাণ করেছে, যদি আরবেরা একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তা ইসরায়েলকে দুর্বল করে দেবে এবং তাদের নেতাদের হিসাব-নিকাশ নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে।
ধনাঢ্য এ ব্যবসায়ী প্রতিবেদনটি ভালোভাবে বিবেচনা করার জন্য নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান জানান। একই সঙ্গে জনগণ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যৌথ অর্থনৈতিক পদক্ষেপের মতো অন্যান্য হাতিয়ারও কাজে লাগাতে বলেন।
খলাফ আহমদ আরও বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট করে ঘোষণা করি, আরবেরা বাস্তব ও কার্যকর চাপের হাতিয়ার রাখে। আমরা যদি এক হই, বিশ্বকে নতুন করে হিসাব করতে হবে। আমাদের ধৈর্য দুর্বলতা নয়; বরং কৌশল।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ২০২০ সালে আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান।
তবে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার ঘটনায় এসব দেশ নিন্দা জানিয়েছে; কিন্তু দেশগুলো এখনো সেই চুক্তি থেকে সরে আসেনি বা স্থগিতও করেনি।
আমিরাত ইসরায়েলের দোহায় হামলাকে বলেছে ‘বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ আগ্রাসন’। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ভবিষ্যতে তাদের কূটনৈতিক অবস্থান বদলের ইঙ্গিত হতে পারে।