
রাজধানীর মিরপুরের কালশীতে ১৬ বিঘার একটি সরকারি খেলার মাঠ দখলের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। পল্লবী থানার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত মাঠটি দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়দের খেলাধুলা ও অবসর সময় কাটানোর একমাত্র উন্মুক্ত স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। তবে সম্প্রতি একটি প্রভাবশালী মহল মাঠটিতে রাবিশ ফেলে এবং টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে দখলের চেষ্টা চালায় বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। এরই মধ্যে ট্রাকভর্তি ময়লা-আবর্জনা ফেলে মাঠটিকে প্রায় অচল করে ফেলা হয়েছে। ফলে খেলাধুলা তো দূরের কথা, সাধারণ চলাচলেরও অনুপযোগী হয়ে পড়েছে জায়গাটি। এ অবস্থায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে জনসাধারণের ব্যবহৃত এই সরকারি সম্পদটি দখলের চেষ্টা চলছে।
বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এক সময়ের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এই খেলার মাঠটি এখন যেন পরিত্যক্ত কোনো নির্মাণ স্থলে পরিণত হয়েছে। মাঠজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে রাবিশ, ময়লা-আবর্জনা ও ধুলাবালি। মাঠের বিভিন্ন জায়গায় ট্রাকে করে আনা রাবিশ, প্লাস্টিকের বর্জ্য ও আবর্জনা স্তূপ করে রাখা হয়েছে। কোথাও আবার ভাঙা কংক্রিট, লোহার টুকরো রাখায় জায়গাটি চলাচলেরও অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। যেখানে প্রতিদিন বিকেল হলেই শিশু-কিশোরদের দৌড়ঝাঁপ, ফুটবল, ক্রিকেট আর খেলাধুলার আনন্দমুখর দৃশ্য দেখা যেত; সেখানে এখন শুধু কাদামাটি, ময়লারস্তুপ আর দুর্গন্ধ। কিছু জায়গায় ফেলে রাখা রাবিশগুলো সমতল করারও চেষ্টা করা হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, মাঠের এই চেহারা দেখে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না যে এটি এক সময় এই এলাকার খেলার মাঠ ছিল। শিশুরা এখন ঘরে বসে মোবাইল গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এ নিয়ে অভিভাবকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
‘এই মাঠটা আমাদের শৈশবের অংশ। প্রতিদিন শত শত ছেলে-মেয়ে এখানে খেলাধুলা করে। আশেপাশে আর কোনো খেলার মাঠ না থাকায় বিকেল হলেই এখানেই ক্রিকেট, ফুটবল খেলে বা অবসর সময় কাটাতো। কিন্তু এখন এই মাঠটি দখলের চেষ্টা চলছে। রাবিশ ফেলা হয়েছে, অথচ কোনো সরকারি নোটিশ নেই, কিছুই জানা নেই’- স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইউনুস
আমিনুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার তিনটি সন্তান রয়েছে। তারা প্রতিদিন এই মাঠে খেলাধুলা করত। কিন্তু এখন মাঠে যাওয়া তো দূরের কথা, সেখানে হাটার মতো পরিবেশ নেই। তারা বিকেলবেলা বাসায় বসে টিভি দেখে কিংবা মোবাইলে গেম খেলে সময় কাটায়। এটা খুবই উদ্বেগজনক। সারাদিন এভাবে মোবাইল আর টিভির সামনে থাকলে ওরা এসবের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়বে। এতে করে শুধু পড়াশোনায় মনোযোগ কমবে না, তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশেও বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।’

স্থানীয়রা জানান, ১৬ বিঘা আয়তনের এই মাঠটি বিগত একটি সরকারের সময়ে সরকারি খেলার মাঠ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। মাঠটি পল্লবীর কালশীর গুরুত্বপূর্ণ একটি খোলা জায়গা, যেটি ‘১৬ বিঘা খেলার মাঠ’ হিসেবে স্থানীয়ভাবে পরিচিত। আশেপাশের কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ক্রীড়া ক্লাব ও শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার একমাত্র অবলম্বন এটি। সম্প্রতি স্থানীয় বাসিন্দারা লক্ষ্য করেন, হঠাৎ ট্রাকযোগে রাবিশ এনে মাঠজুড়ে ফেলা হচ্ছে। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, এটি হয়তো ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কোনো মাঠের জন্য সংস্কার প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। কিন্তু পরে জানতে পারেন এটি সিটি কর্পোরেশনের কোন প্রকল্প নয়, একটি বাইয়িং হাউজ মাঠটি দখলের চেষ্টা করছে। যদিও সংশ্লিষ্ট বাইয়িং হাউজের নাম কেউ সঠিক জানাতে পারেনি, তবে স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক মদদপুষ্ট কোনো গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে মাঠটি দখল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। দখলের জন্য দেওয়া টিনের বেড়াগুলো সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে সড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
মাঠটি রক্ষায় স্থানীয় বাসিন্দা ও আশেপাশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা গত ২ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টা ৩০ মিনিট থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কালশী ফ্লাইওভারের উত্তর-পূর্ব পাশে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। তবে তাদের অভিযোগ, এত বড় একটি জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যু হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত মাঠ রক্ষায় কোনো সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়েনি। পল্লবী থানা ও সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলেও জানিয়েছেন তারা।
মাঠের একদম পাশে বসবাসকারী স্থানীয় বাসিন্দা ও খেলার মাঠ রক্ষার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মো. ইউনুস। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এই মাঠটা আমাদের শৈশবের অংশ। প্রতিদিন শত শত ছেলে-মেয়ে এখানে খেলাধুলা করে। আশেপাশে আর কোনো খেলার মাঠ না থাকায় বিকেল হলেই এখানেই ক্রিকেট, ফুটবল খেলে বা অবসর সময় কাটাতো। কিন্তু এখন এই মাঠটি দখলের চেষ্টা চলছে। রাবিশ ফেলা হয়েছে, অথচ কোনো সরকারি নোটিশ নেই, কিছুই জানা নেই।’
‘এটি সম্ভবত জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের। স্থানীয় যারা এসেছিলেন তাদেরকে আমি গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে বলেছি।’ মাঠটি কে বা কারা দখলের চেষ্টা করছেন তাদের ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না’- পল্লবী থানার ওসি শফিউল আলম
ইউনুস আরও জানান, বর্তমানে মাঠটি খেলার একেবারেই অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় তারা স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। নেতারাও তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। সেই সঙ্গে মাঠ দখলের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছেন। গত ২ সেপ্টেম্বর মাঠ রক্ষায় একটি মানবন্ধন করা হয়।
তিনি বলেন, ‘আমরা সিটি কর্পোরেশন এবং পল্লবী থানাকেও বিষয়টি জানিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রশাসন দখলকারীদের শনাক্ত বা প্রতিরোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। মাঠটি রক্ষায় আমরা দ্রুত প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চাই। অন্যথায় আমরা আরও কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবো।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আল মামুন বলেন, ‘সরকারি জমি পেশিশক্তি দিয়ে দখল করার চেষ্টা আইন অনুযায়ী একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জমিটি সরকারের কোন সংস্থার নামে রয়েছে—জেলা প্রশাসক, রাজউক, গৃহায়ণ বা রেলওয়ের অধীনে কিনা, তা যাচাই করা। তবে যেহেতু সরকার জমিটিকে খেলার মাঠ হিসেবে ঘোষণা করেছে, সেহেতু কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষে সেটি দখল করা কিংবা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই।’
এ বিষয়ে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিউল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এটি সম্ভবত জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের। স্থানীয় যারা এসেছিলেন তাদেরকে আমি গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে বলেছি।’ মাঠটি কে বা কারা দখলের চেষ্টা করছেন তাদের ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।’
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সম্পতি কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মারুফা বেগম নেলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘সম্পত্তির অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়েছি মাত্র দেড় মাস আগে। মাঠ দখলের বিষয়টি এখনো আমার জানা নেই। অফিসে আলোচনা করে বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’